Your Ads Here 100x100 |
---|
ফিচার :
১৮ জুলাই। নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিন। পৃথিবীর ইতিহাসে যে কয়েকজন মানুষের নাম মানেই এক প্রতিবাদের প্রতীক, ন্যায়বিচারের জীবন্ত কণ্ঠস্বর– ম্যান্ডেলা তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তাঁকে স্মরণ মানেই ফিরে দেখা নৃশংস বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এক অদম্য সংগ্রাম, ক্ষমা ও পুনর্মিলনের রাজনীতি; যেখানে সবচেয়ে বড় কথা– একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীকে ভালোবাসার ভিত্তিতে গড়ে তোলার প্রয়াস।
এই বিশেষ দিনটিকে জাতিসংঘ প্রতিবছরই উদযাপন করে ‘ম্যান্ডেলা দিবস’ হিসেবে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে– ‘দারিদ্র্য ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই এখনও আমাদের হাতে’। এটি যেন ম্যান্ডেলার জীবন দর্শনেরই সম্প্রসারণ।
এ বছর ১৮ জুলাই নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদরদপ্তরের সাধারণ পরিষদ হলে আয়োজিত হচ্ছে এক বিশেষ স্মরণসভা, যেখানে দেওয়া হবে ২০২৫ সালের নেলসন রোলিহলাহলা ম্যান্ডেলা পুরস্কার। পুরস্কারপ্রাপ্তদের একজন হলেন ব্রেন্ডা রেনল্ডস, কানাডার সালতো জনগোষ্ঠীর এক নারী, যিনি আদিবাসী সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করছেন। অন্যজন কেনেডি ওদেদে, যিনি বেড়ে উঠেছেন নাইরোবির কুখ্যাত কিবেরা বস্তিতে, আর পরে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘শাইনিং হোপ ফর কমিউনিটিজ’ নামে একটি সংস্থা, যা দারিদ্র্য ও লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিবেদিত। বিজয়ীদের পুরস্কার তুলে দেবেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও সাধারণ পরিষদের সভাপতি ফিলেমন ইয়াং।
মুক্তির পাথেয়
নেলসন ম্যান্ডেলার জীবন এক জীবন্ত উপন্যাস– নাটকীয়তায় পূর্ণ; কিন্তু আত্মত্যাগ, ন্যায়বোধ আর উদারতার সূক্ষ্ম সুতায় গাঁথা। ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার এক গ্রামে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি ছিলেন আইনজীবী, রাজনৈতিক কর্মী, প্রতিবাদী এবং সবশেষে রাষ্ট্রনায়ক। ২৭ বছরের দীর্ঘ কারাবাস শেষে যখন তিনি মুক্ত হন, তখন তাঁর জনগণ ক্ষত-বিক্ষত, বিভক্ত এবং প্রতিশোধপ্রবণ। ম্যান্ডেলা এর বিপরীতে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, ক্ষমা করতে শেখো।
তিনি গড়ে তুললেন ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন– এক ন্যায়বিচার সংস্থা। যার উদ্দেশ্য– অতীতের নৃশংসতা ভুলে যাওয়া নয়; বরং সত্য উদ্ঘাটন, গ্রহণ এবং তার মধ্য দিয়ে সামাজিক পুনর্গঠন। এই কমিশন সমানভাবে তদন্ত করেছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও মুক্তিকামীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ। কেউ কেউ ম্যান্ডেলার এই ক্ষমার পথকে দুর্বলতা বলেছিলেন। তাঁকে ‘আফ্রিকান আঙ্কেল টম’ বলেও হেয় করেছিলেন কেউ কেউ; কিন্তু ম্যান্ডেলা তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি বলতেন, ‘সহিংস মানুষ নয়, কলুষিত ব্যবস্থাকে ঘৃণা করো।’ তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করতে শত্রুকেও আলিঙ্গন করতে হয়। তিনি নিজেই প্রেসিডেন্টের পদে বসিয়ে দেন তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রেডেরিক ডি ক্লার্ককে। তিনি বলেন, ‘শান্তি মানে শুধু সংঘাতের অনুপস্থিতি নয়; শান্তি মানে এমন এক পরিবেশ, যেখানে সবাই বিকশিত হতে পারে– জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা শ্রেণি নির্বিশেষে।’
ম্যান্ডেলার প্রাসঙ্গিকতা
আজকের বিশ্বে যখন গণতন্ত্র হুমকির মুখে, গণআন্দোলনের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে, যুদ্ধ আর নিপীড়নে পিষ্ট হচ্ছে মানুষ– তখন ম্যান্ডেলার জীবন যেন এক দ্যুতি ছড়ানো বাতিঘর। তিনি মারা গেছেন ২০১৩ সালে। কিন্তু সত্যিই কি তিনি মারা গেছেন? তিনি বেঁচে আছেন গাজায় ফিলিস্তিনি জনতার প্রতিরোধে, বেঁচে আছেন পেরুর আন্দিজ পর্বতে ভূমি-অধিকারের দাবিতে দাঁড়ানো আদিবাসীদের কণ্ঠে, বেঁচে আছেন কাশ্মীরি শিশুর ঢিল ছোড়া প্রতিবাদে, বেঁচে আছেন ঢাকার রাস্তায় স্লোগান দেওয়া তরুণ-তরুণীর সাহসে, যারা গুলি খেয়ে পড়ে যান; কিন্তু মাথা নোয়ান না।
তাদের কণ্ঠে আজ আমরা শুনি সেই পুরোনো স্লোগান– ‘আজাদি!’
ম্যান্ডেলার মতো তারাও বলছেন, ‘স্বাধীনতা মানে শুধু শৃঙ্খল ভাঙা নয়, বরং এমনভাবে বাঁচা, যাতে অন্যের স্বাধীনতাও সমুন্নত থাকে।’
ম্যান্ডেলা আমাদের মাঝে নেই– এই সত্যের চেয়েও গভীর সত্য হলো, তিনি আছেন আমাদের সাহস, সংগ্রাম আর বিশ্বাসের মাঝে।