রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) চিরকালই নরম মনের মানুষ ছিলেন। কোনোদিনই ঝগড়া-বিবাদ-বিসম্বাদ পছন্দ করেননি। মানবতার অবদমন, নিপীড়ন-নির্যাতন তাঁর কাছে ছিলো অসহনীয়। এমনকি ক্লাসের ছাত্রদের শাস্তিদান বেত্রাঘাত তাঁর পছন্দনীয় ছিলো না। মানুষের আত্মশক্তির উদ্বোধনকেই তিনি আজীবন কামনা করেছেন। আর মনুষ্যত্বের চর্চা ও সাধনা করেছেন। কেননা গাছপালা, পশু-পাখি, স্বভাবতই বেড়ে ওঠে। কিন্তু মানুষকে সাধনার মাধ্যমেই মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। এ লক্ষ্যেই তিনি শান্তিনিকেতনে একটি শান্তির আশ্রম খুলেছিলেন; তখন তাঁর বয়স চল্লিশ এবং আরও চল্লিশটি বছর তিনি সেই সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। তাঁর জীবনের শেষ সিকি শতাব্দীতে তিনি দু’দুটো বিশ^যুদ্ধ দেখেছেন, সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের উত্থান, মনুষ্যত্বের অবমাননা, নিপীড়ন ও যুদ্ধের ভয়াবহ তাণ্ডব ও ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছেন।
তাই তো তিনি সাম্রাজ্যবাদী-ফ্যাসিবাদী যুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, গেয়েছেন মানবতা ও বিশ্বশান্তির জয়গান। তাঁর জন্ম ১২৬৮ সনের ২৫ বৈশাখ এবং মারা যান ১৩৪৮ সালের ২২ শ্রাবণ। ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বলেন- সমস্ত ইউরোপে আজ এক মহাযুদ্ধের ঝড় উঠেছে-কতদিন ধরে গোপনে গোপনে এই ঝড়ের আয়োজন চলছিল। অনেকদিন থেকে আপনার মধ্যে আপনাকে যে মানুষ কঠিন করে বন্ধ করেছে, আপনার জাতীয় অহমিকাকে প্রচন্ড করে তুলেছে, তার সেই অবরুদ্ধতা আপনাকেই আপনি একদিন বিদীর্ণ করবেই করবে।… আজ মানুষ মানুষকে পীড়ন করবার জন্য নিজের এই অমোঘ ব্রহ্মাস্ত্রকে ব্যবহার করছে। তাই সেই ব্রহ্মাস্ত্র আজ তারই বুকে বেজেছে।
…(প্রতিরোধ প্রতিদিন’, সম্পাদনা: দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃ: ৩২২) প্রথম সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের মূল কারণ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন- …পৃথিবীর ইতিহাসে সম্পূর্ণ একটা নূতন কান্ড ঘটিতেছে-তাহা এক দেশের উপর আর এক দেশের রাজত্ব এবং সেই দুই দেশ সমুদ্রের দুই পাড়ে। এত বড়ো বিপুল প্রভুত্ব জগতে আর কখনো ছিল না। য়ুরোপের সেই প্রভুত্বের ক্ষেত্র এশিয়া ও আফ্রিকা।এখন মুশকিল হইয়াছে জর্মানির। তার ঘুম ভাঙ্গিতে বিলম্ব হইয়াছিল। সে ভোজের শেষ বেলায় হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া উপস্থিত।… আজ ক্ষুধিত জর্মানির বুলি এই যে, প্রভু এবং দাস এই দুই জাতের মানুষ আছে। প্রভু সমস্ত আপনার জন্য লইবে, দাস সমস্তই প্রভুর জন্য জোগাইবে-যার জোর আছে সে রথ হাঁকাইবে, আর যার জোর নাই সে পথ ছাড়িয়া দিবে। য়ুরোপের বাহিরে যখন এই নীতির প্রচার হয় তখন য়ুরোপ ইহার কটুত্ব বুঝিতে পারে না। আজ তাহা নিজের গায়ে বাজিতেছে। (লড়াইয়ের মূল : রবীন্দ্ররচনাবলী’ ত্রয়োদশ খন্ড, সন ১৩২১/১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ এবং প্রতিরোধ প্রতিদিন’, পৃ: ৩২২।)
১৯১৭ সালে মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল মহান রুশ বিপ্লব। তা গোটা পৃথিবীর সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মেহনতি মানুষকে নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত করেছিলো। পাশাপাশি ইতালিতে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদের উত্থানপর্বও শুরু হয়ে যায়। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ইতালি পরিভ্রমণ করেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথকে রাজকীয় ভোজসভায় আমন্ত্রণ জানান মুসোলিনি। জনকল্যাণের মুখোশধারী মুসোলিনির আতিথেয়তার মুগ্ধ হন রবীন্দ্রনাথ। সেদিন রবীন্দ্রনাথ সপ্রশংস বক্তব্যও রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর এ ভুল ভাঙতে বেশি দেরি হয়নি। রমাঁ রোলাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পরই তিনি ফ্যাসিবাদের অন্দরমহল সম্পর্কে ধারণা পান। তিনি ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে বলেন- ইতালির বর্তমান সমৃদ্ধিকে মানিয়া লইয়াও যদি দেখা যায় উহা অর্জনের জন্য যে-পন্থা ও প্রক্রিয়া অনুসৃত হইয়াছে তা নীতিবিবর্জিত এবং ধরিত্রীর অবশিষ্টাংশের পক্ষে বিপদস্বরূপ, তবে তাহাকে বিচার করিবার অধিকার আমাদের অবশ্যই আছে।
গভর্নমেন্টের বাক-স্বাধীনতা অপহরণের কুৎসিৎ অপরাধ এবং বিশ্বশান্তির পক্ষে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী উচ্চাকাঙ্ক্ষায় আমি উহারই প্রকাশ উপলব্ধি করিয়াছি। (দ্য স্টার’, লন্ডন, ৫ আগস্ট ১৯২৬ এবং ‘প্রতিরোধ প্রতিদিন’, পৃ: ৩২২-৩২৩) ফ্যাসিবাদের উত্থানে উদ্বিগ্ন হয়ে বন্ধু চার্লস ফ্রীয়ার য়্যান্ড্রুজকে তিনি এক চিঠিতে লিখেছেন- ফ্যাসিবাদের কর্মপদ্ধতি ও নীতি সমগ্র মানবজাতির উদ্বেগের বিষয়। যে আন্দোলন নিষ্ঠুরভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে দমন করে, বিবেক-বিরোধী কাজ করতে মানুষকে বাধ্য করে এবং হিংস্র রক্তাক্ত পথে চলে বা গোপনে অপরাধ সংঘটিত করে-সে আন্দোলনকে আমি সমর্থন করতে পারি এমন উদ্ভট চিন্তা আসার কোনো কারণ নেই। আমি বারবারই বলেছি পশ্চিমের রাষ্ট্রগুলি সযত্নে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব লালন-পালন করে সারা পৃথিবীর সামনে ভয়াবহ বিপদের সৃষ্টি করেছে। (ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’, লন্ডন, ৫ আগস্ট ১৯২৬ এবং প্রতিরোধ প্রতিদিন’, পৃ: ৩২৩) ১৯২৭ সালের ১০-১৫ ফেব্রুয়ারি ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত হয় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন।
এ সম্মেলনের পক্ষ থেকে বারব্যুস রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লেখেন মুক্ত চেতনার প্রতি আবেদন’-এ স্বাক্ষরদানের জন্য। আবেদনে বলা হয়েছিল- …আমরা সর্বত্র লক্ষ্য করছি যে ফ্যাসিবাদের নামে, স্বাধীনতার সমুদয় বিজয়কে হয় ধ্বংস নতুবা বিপদাপন্ন করা হচ্ছে। সংগঠন গড়ার অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ ও বিবেকের স্বাধীনতা-যাহা শত শত বৎসরের আত্মত্যাগ ও আয়াসে অর্জিত হয়েছে-আজ সেই পথকে নিষ্ঠুরভাবে নির্মূল করা হচ্ছে। প্রগতির এই দেউলিয়া অবস্থায় আমরা আর নীরব দর্শকের ভ‚মিকায় থাকিতে পারি না। (প্রতিরোধ প্রতিদিন’, প্রাগুক্ত, পৃ: ৩-৪) ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সেই আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করে রবীন্দ্রনাথ বারব্যুসকে একটি সুন্দর উত্তর দেন- বলাই বাহুল্য যে আপনার আবেদনের প্রতি আমার সহানুভ‚তি আছে। আমি স্পষ্ট বুঝছি এই আবেদনের আরও অসংখ্যের কণ্ঠ ধ্বনিত করছে-সভ্যতার অন্তঃস্থল থেকে হিংসার আকস্মিক বিস্ফোরণে যাঁরা বিষন্ন।…
(বিশ্বভারতী কোয়ার্টার্লি’, শান্তিনিকেতন, জুলাই ১৯২৭ এবং ‘প্রতিরোধ প্রতিদিন’, পৃ: ৩২৩) ১৯২৭ সালে আঁরি বারব্যুস ও রমাঁ রোলাঁর উদ্যোগে গঠিত হয়েছিলো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লীগ’। এ সংগঠনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন মাদাম সুন ইয়াট-সেন, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, আপটন সিনক্লেয়ার, আঁরি বারব্যুস, ম্যাক্সিম গোর্কি, উইলি সুনজেনবুর্ক, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। এ সংগঠনের সাথে একাত্ম ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সোমেন চন্দ’ গ্রন্থে তার কিছুটা বিবরণ লক্ষ করা যায়- ১৯২৭-এর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ‘সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংঘের’ উদ্যোগে ব্রাসেল্স্-এ পৃথিবীর নির্যাতিত জাতিগুলির মহাসম্মেলনে অনেক মনীষীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বাণীও পাঠ করা হয়। ১৯৩২-এর ২৭-২৮ আগস্ট বারব্যুস ও রোলাঁ আর্মস্টার্ডামে বিশ্বশান্তি সম্মেলন আহ্বান করেন। রবীন্দ্রনাথ সেই সম্মেলনে বাণী পাঠিয়েছিলেন বলে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি এই সম্মেলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন। সাংগঠনিক কমিটিতেও তাঁর নাম ছিল। (সোমেনচন্দ, সম্পাদক: সাধন চট্টোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থবর্মণ চৌধুরী, পৃ: ১০২) ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েত ভ্রমণ করেন। সে এক নতুন অভিজ্ঞতা। তিনি নিজেই বলেছেন এমন দেশে না এলে জীবনটাই অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি সোভিয়েত সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় মনোযোগী হয়ে পড়েন।
তাইতো ১৯৩১ সালের মার্চ মাসে জাপান মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করলে জাপানি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রথম দিন থেকেই রুখে দাঁড়িয়েছিলো একমাত্র সমাজতন্ত্রের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৩৩ সালের ফ্যাসিস্ট হিটলারের আবির্ভাব ঘটে জার্মানিতে। ক্ষমতারোহ করেই ১৯৩৩ সালের ১০ মে বার্লিনের রাজপথে বিশ^খ্যাত লেখকের সাহিত্যকর্মের বহ্নুৎসব করে। তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি’ও অন্তর্ভুক্ত ছিলো। হিটলার-মুসোলিনির সাম্রাজ্যগ্রাসী লালসায় মানবতা বিধ্বংসী নীতি ও যুদ্ধপ্রস্তুতির বিরুদ্ধে তাবদ ইউরোপের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরাও প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রয়াস নেন। তাঁদের মধ্যে রমাঁ রোলাঁ, বারব্যুস, গোর্কি প্রমুখ অন্যতম।। ১৯৩৫ সালের ২১ জুন প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন সংস্কৃতি রক্ষায় লেখকদের বিশ্ব কংগ্রেস’।
সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন জিদ, ফস্টার, মালরো, হাক্সলি, স্ট্রাচি প্রমুখ বিশ্বখ্যাত মনীষীরা। তাঁরা বিশ্বের কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। সেই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রবাসী ভারতীয় প্রতিনিধি ছিলেন পুষ্পক রাজআনন্দ। এমনি একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগের প্রতি রবীন্দ্রনাথ সম্মতিপ্রকাশ করবেন এটা স্বাভাবিক। সোমেন চন্দ’ গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে- ১৯৩৫-এর ১১ নভেম্বর প্যারিসে একটি শান্তি সম্মেলনের আহ্বান করেন বারব্যুস ও রোঁল্যা। ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ্যে বারব্যুসের একটি আবেদন ১৯৩৫-এর ৯ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ভারতবর্ষের চিন্তাশীল মানুষেরা শান্তি সম্মেলনে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন। সিদ্ধান্ত হয়-রবীন্দ্রনাথ, গান্ধিজী, সরোজিনী নাইড়– ও রমানন্দ চট্টোপাধ্যায় এই শান্তি সম্মেলনে ভারতবর্ষের প্রতিনিধিত্ব করবেন। এই সময়ে বিশ্বশান্তি কংগ্রেসের পক্ষে ভারতেও একটি ‘জাতীয় উদ্যোগ কমিটি’ গঠিত হয়।
এই কমিটিতে অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথও ছিলেন। বারব্যুসের আকস্মিক মৃত্যুতে বিশ^শান্তি কংগ্রেস পিছিয়ে গিয়ে ব্রাসেলস-এ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৬-এর ৩-৬ সেপ্টেম্বর। ঐ সম্মেলনে ‘ভারতীয় প্রগতি লেখক সঙ্ঘের’ পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, প্রমথ চৌধুরী, প্রফুল্লচন্দ্র রায়ও আরো অনেকের স্বাক্ষরযুক্ত বাণী পাঠানো হয়। ঐ সম্মেলনে রবীন্দ্রনাথ স্বতন্ত্রভাবেও একটি বাণী পাঠান। (সোমেন চন্দ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০২) ১৯৩৬ সালের ১০ এপ্রিল ল²ৌতে নিখিল ভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘ গঠিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ নানাভাবে এ সংগঠনকে সহযোগিতা করেন। সে বছর মুসোলিনি ইথিওপিয়া আক্রমণ করলে কোলকাতায় তুমুল প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীরা একত্রে মিলিত হয়ে ২৭ অক্টোবর যুদ্ধ ও ফ্যাসিবিরোধী সংঘ-র সাংগঠনিক কমিটি গঠন করেন। ১৯৩৬ সালের ১৮ জুলাই হিটলার-মুসোলিনি চক্রের প্রত্যক্ষ মদদে স্পেনেও ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। এ গৃহযুদ্ধে পৃথিবীর সকল শান্তিকামী মানুষেরা সাধারণতন্ত্রীদের পক্ষে যোগ দেন এবং গঠন করেন আন্তর্জাতিক ব্রিগেড। ১৯৩৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ব্রাসেলসে বিশ্বশান্তি সম্মেলনে একটি ইশতাহার প্রেরণ করা হয় ভারতের লেখক, শিল্পী ও মনীষীদের পক্ষ থেকে। তার নিচে অন্যান্যদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথও স্বাক্ষর করেছিলেন।
তাতে সুস্পষ্ট উচ্চারণ ছিলো- …আমরা এই সুযোগে আমাদের ও আমাদের দেশবাসীর পক্ষ হইতে অন্যান্য দেশের জনসাধারণের সহিত সমস্বরে বলিতেছি যে, আমরা যুদ্ধকে ঘৃণা করি এবং যুদ্ধ পরিহার করিতে চাই; যুদ্ধে আমাদের কোনো স্বার্থ নাই। কোনো সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে ভারতবর্ষের যোগদানের আমরা ঘোর বিরোধী, কারণ আমরা জানি যে আগামী যুদ্ধে সভ্যতা ধ্বংস হইবে। সোভিয়েত ইউনিয়নই হউক, বা নাৎসি জার্মানি হউক-যেখানে সংস্কৃতি বিপন্ন হইবে সেখানেই উহার রক্ষার জন্য আমরা উদগ্রীব এবং আমাদের মহৎ উত্তরাধিকার রক্ষার জন্য আমরা যথাশক্তি সংগ্রাম করিব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রমথ চৌধুরী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, নন্দলাল বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, প্রেমচাঁদ, জওহরলাল নেহরু প্রমুখ।
(১৪ ভাদ্র ১৩৪৩)প্রতিরোধ প্রতিদিন’, প্রাগুক্ত, পৃ-৬৬) ১৯৩৬ সালের ২০ ডিসেম্বর ফ্যাসিস্ট বর্বরতা প্রতিহত করার জন্য রমাঁ রোলাঁ বিশ^বাসীর কাছে আহŸান জানান। ১৯৩৭ সালের জানুয়ারি মাসে মডার্ন রিভ্যুউ’ পত্রিকায় তার অনুবাদ প্রকাশিত হলে ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে ব্যাপক সাড়া জাগে। ১৯৩৭ সালের মার্চ মাসে কোলকাতায় ফ্যাসিবাদ ও যুদ্ধবিরোধী সংঘ’ এর সর্বভারতীয় কমিটি গঠিত হলে উহার সভাপতি হন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৭ সালের ৩ মার্চ দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের মানবতার বিবেকের কাছে আবেদন’ ঐতিহাসিক বিবৃতি। সেখানে উল্লিখিত ছিলো- স্পেনে আজ বিশ্বসভ্যতা পদদলিত।
স্পেনের জনগণের গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে ফ্রাঙ্কো বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়েছে। অর্থ ও জনবল দিয়ে বিদ্রোহে সাহায্য করছে আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদ। …আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদের এই প্রলয়ঙ্কর বন্যাকে রোধ করতেই হবে। … স্পেনের গণফ্রন্টের পাশে দাঁড়ান, জনগণের সরকারকে সাহায্য করুন, লক্ষ কণ্ঠে ধ্বনি তুলুন-প্রতিক্রিয়া দূর হও’। (সোমেন চন্দ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০২-১০৩) ১৯৩৮ সালের ১২ মার্চ হিটলার অস্ট্রিয়া আক্রমণ করে। ১২ সেপ্টেম্বর হিটলার চেকো¯েøাভাকিয়াকে রণহুঙ্কার দেয়। ১৫ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ চেক জনসাধারণের প্রতি আন্তরিক সহানুভ‚তি জানিয়ে চেক কবি ভি লেসানকে চিঠি লেখেন এবং তার সঙ্গে প্রায়শ্চিত্ত’ কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদটি পাঠিয়ে দেন। চিঠির একস্থানে লিখেছেন- আপনার দেশের জনগণের দুঃখে আমি সম্পূর্ণ একাত্ম-সমব্যাথী। আপনাদের দেশে যা ঘটেছে তা সহানুভ‚তি যোগ্য স্থানীয় দুর্ভাগ্যমাত্র নয়। এ এক মর্মান্তিক উদঘাটন যা দেখিয়ে দিচ্ছে গত তিন শতাব্দী ধরে যে সব আদর্শ ও নীতিবোধের চর্চা আর অর্জনে পশ্চিমের জনগণ প্রাণও দিয়েছেন, আজ তার অভিভাবকত্ব বর্তেছে একদল কাপুরুষের হাতে। এই কাপুরুষ দল আত্মরক্ষার সংকীর্ণ মূল্যে অর্জিত সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছে। (হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’, কোলকাতা।
১০ নভেম্বর ১৯৩৮, প্রতিরোধ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২৭) ১৯৩৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর চেক প্রেসিডেন্ট বেনেসের কাছে এক তার বার্তায় তীব্র ক্ষোভ ও বেদনা প্রকাশ করেন রবীন্দ্রনাথ। তার আগে অমিয় চক্রবর্তীকেও নিজের মর্মবেদনা প্রকাশ করে লিখেছিলেন- দেখলুম দূরে বসে ব্যথিত চিত্তে, মহাসাম্রাজ্যশক্তি রাষ্ট্রমন্ত্রীরা নিষ্ক্রিয় ঔদাসীন্যের সঙ্গে দেখতে লাগল জাপানের করাল দংষ্ট্রাপংক্তির দ্বারা চীনকে খাবলে খাবলে খাওয়ায়, অবশেষে সেই জাপানের হাতে এমন কুশ্রী অপমান বারবার স্বীকার করল যা তার প্রাচ্য সাম্রাজ্যের সিংহাসনচ্ছায়ায় কখনও ঘটেনি। দেখলুম ঐ স্পর্ধিত সাম্রাজ্যশক্তি নির্বিকার চিত্তে আবিসিনিয়াকে ইটালির হা করা মুখের গহ্বরে তলিয়ে যেতে দেখল, মৈত্রীর নামে সাহায্য করল জর্মানির বুটের তলায় গুড়িয়ে ফেলতে চেকো¯øাভিয়াকে; দেখলুম নন-ইন্টারভেনশনের জটিল প্রণালিতে স্পেনের রিপাবলিককে দেউলে করে দিতে-দেখলুম ম্যুনিক প্যাক্টে নতশিরে হিটলারের কাছে একটা অর্থহীন সই সংগ্রহ করে অপরিমিত আনন্দ প্রকাশ করতে। …মানব ইতিহাসে ফ্যাসিজমের কলঙ্ক প্রলেপ আর সহ্য হয় না। চিঠিপত্র’ : একাদশ খন্ড, ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯, ‘প্রতিরোধ প্রতিদিন’, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২৭-২৮) ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর পোল্যান্ড আক্রমণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সূচনা করে।
৯ সেপ্টেম্বর কোলকাতায় ইন্দো-পোলিস অ্যাসোসিয়েশন’ গঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ তার সভাপতি হতে সম্মত হন। তিনি অত্যন্ত ব্যথিত চিত্তে দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেছিলেন- জার্মানির বর্তমান শাসকের দাম্ভিক ন্যায়হীনতায় বিশ্বের বিবেক আজ গভীরভাবে আহত। বর্তমান পরিস্থিতি পূর্বের অনেকগুলি ক্ষেত্রে দুর্বলের অসহায় পীড়নের চূড়ান্ত পরিণতি। … আমি কেবলমাত্র এই আশা প্রকাশ করতে পারি যে মানবজাতি এই পরীক্ষায় জয়যুক্ত হোক। সর্বকালের জন্য জীবনের সূচিতা এবং অত্যাচারিত জনগণের স্বাধীনতা দৃঢ় চিত্তে প্রতিষ্ঠিত হোক। পৃথিবী এই রক্ত¯œানের ধারায় চিরতরে কালিমামুক্ত হোক। (মডার্ন রিভিউ, অক্টোবর ১৯৩৯,প্রতিরোধ প্রতিদিন’, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২৮) ১৯৩৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর এক পত্র-প্রবন্ধে তিনি লেখেন- এই যুদ্ধে ইংল্যান্ড-ফ্রান্স জয়ী হোক একান্ত মনে এই কামনা করি। কেননা মানব ইতিহাসে ফ্যাসিজমের নাৎসিজমের কলঙ্ক প্রলেপ আর সহ্য হয় না। (সোমেন চন্দ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৪) তারপর থেকে যুদ্ধ পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ হতে শুরু করে। রবীন্দ্রনাথও শারীরিকভাবে দুর্বল হতে থাকেন। কিন্তু মনোবল তাঁর অটুট ছিলো চেতনহীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। ১৯৪০ সালের ১৫ জুন তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছে জরুরি তারবার্তায় হিটলারের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খুলবার আবেদন জানান।
১৯৪১ সালের ১ বৈশাখ শান্তিনিকেতনে কবির জীবদ্দশায় সর্বশেষ জন্মদিন পালিত হয়। সেখানে তিনি ‘সভ্যতার সংকট’ নামে প্রবন্ধ পাঠ করেন, তা মানবসভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দলিলের মধ্যে একটি। কবির সারাজীবনের বিশ্বাস এবং উপলব্ধির কথাই তিনি সেদিন ঘোষণা করেছিলেন। দিন দিন স্বাস্থ্যহানি ঘটতে থাকলেও শান্তির জন্য তাঁর প্রয়াস শেষ হয় না। ১৯৪১ সালের ৫ জুন তিনি মিস রাখবোন-এর উদ্দেশে এক খোলা চিঠি লেখেন; সেটিরও ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। ১৯৪১ সালের ২২ জুন হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলো। কবি তখন গভীর রোগশয্যায়। তাঁকে অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে কোলকাতা, ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে গঠিত হয়েছিলো সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি। কোলকাতায় সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি ২০ জুলাই বাংলার বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের একটি বিবৃতি প্রচার করেছিলেন।
কিন্তু অসুস্থ কবি ছিলেন শান্তিনিকেতনে। তাঁকে অস্ত্রোপচারের জন্য কোলকাতায় আনা হবে। ৩০ জুলাই তাঁর দেহে অস্ত্রোপচার হবে। অসুস্থতা ও শঙ্কার মধ্যেও কবি সব সময় অন্যের কাছ থেকে যুদ্ধ পরিস্থিতির সংবাদ শুনেছেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। সেদিন সকালে প্রশান্তকুমার মহালনবীশ ও নির্মল কুমারী মহালনবীশ গিয়েছিলেন তাঁকে দেখতে। সে সময়কার সুন্দর একটি চিত্র অঙ্কিত হয়েছে সোমেন চন্দ’ গ্রন্থে। প্রশান্তকুমার মহালনবীশ লিখেছেন- যে দিন অপারেশন করা হয় সেদিন সকাল বেলা অপারেশনের আধঘণ্টা আগে আমার সঙ্গে তাঁর শেষ কথা: ‘রাশিয়ার খবর বলো।’ বললুম, একটু ভালো মনে হচ্ছে, হয়তো একটু ঠেকিয়েছে।’ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, হবে না? ওদেরই তো হবে। পারবে, ওরাই পারবে।’ এই অপারেশনের কয়েকদিন পর ৭ আগস্ট ১৯৪১…রবীন্দ্রনাথের জীবনাবসান হয়। রবীন্দ্রনাথের কথাই ফলেছিলো চরম পরিণতি হয়েছিলো ফ্যাসিস্টদের!!