Your Ads Here 100x100 |
---|
আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
বিশ্বের সবচেয়ে বড় সৌর দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে তোলা সূর্যের এক নতুন ছবি প্রকাশ পেয়েছে, যা সূর্যের পৃষ্ঠকে নজিরবিহীন বিশদতায় দেখিয়েছে এবং এর জ্বলন্ত জটিলতা সম্পর্কে নতুন আলোকপাত করেছে।
এই ছবিটি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের ড্যানিয়েল কে. ইনোই সৌর দূরবীক্ষণ যন্ত্রের নতুন ভিজিবল টিউনেবল ফিল্টার (VTF) দিয়ে প্রথমবারের মতো তোলা হয়েছে। এই অত্যাধুনিক যন্ত্রটি সূর্যের পৃষ্ঠে যা ঘটছে, তার এক অনন্য তিন-মাত্রিক চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম বলে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
এই ক্লোজ-আপ ছবিতে সূর্যের অভ্যন্তরীণ বায়ুমণ্ডলের কেন্দ্রের কাছে বিশালাকৃতির (মহাদেশের সমান) গাঢ় রঙের সানস্পটের একটি গুচ্ছ দেখা যায়, যার প্রতিটি পিক্সেল প্রায় ১০ কিলোমিটার বা ৬.২ মাইলের সমান।
এই গাঢ় ছোপগুলো সূর্যের অত্যন্ত চৌম্বকীয়ভাবে সক্রিয় অঞ্চল, যেখান থেকে সোলার ফ্লেয়ার বা করোনাল ম্যাস ইজেকশন (CME) হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। CME হলো সূর্যের বাইরের বায়ুমণ্ডল থেকে নির্গত আয়নিত গ্যাস এবং চৌম্বক ক্ষেত্রের এক বিশাল বিস্ফোরণ।
এই ধরনের উচ্চ-বিশদ ছবি বিজ্ঞানীদের জন্য সূর্যের আচরণ বোঝা এবং ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে সম্ভাব্য ক্ষতিকর সৌর ঝড় সম্পর্কে। ইনোই টেলিস্কোপের বিজ্ঞানী ফ্রিডরিখ ওয়োগার এক ইমেইলে বলেন, “১৮০০-এর দশকে ঘটে যাওয়া ক্যারিংটন ইভেন্ট এতটাই তীব্র ছিল যে, টেলিগ্রাফ স্টেশনগুলোতে আগুন লেগে গিয়েছিল। আমাদের এই ধরনের মহাজাগতিক ঘটনার চালক কারণগুলো বুঝতে হবে এবং কীভাবে তা প্রযুক্তি ও মানবজীবনে প্রভাব ফেলে তা অনুধাবন করতে হবে।”
সূর্য থেকে আসা এই শক্তিশালী বিস্ফোরণ পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে, যার ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ও স্যাটেলাইট নির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
সূর্যের চৌম্বকীয় কর্মকাণ্ড একটি ১১ বছরব্যাপী চক্রে ওঠানামা করে। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে NOAA, NASA এবং আন্তর্জাতিক সৌর চক্র পূর্বাভাস প্যানেল ঘোষণা করে যে সূর্য বর্তমানে তার সর্বোচ্চ চৌম্বকীয় সক্রিয়তার ধাপে, অর্থাৎ ‘সোলার ম্যাক্সিমাম’-এ পৌঁছেছে। এই সময়ে সূর্যের চৌম্বক মেরুগুলো স্থান পরিবর্তন করে এবং বেশি সংখ্যক সানস্পট দেখা যায়।
এই সময়টি ইনোই টেলিস্কোপের জন্য যথাযথ, কারণ তারা এখন যন্ত্র পরীক্ষার সময় সূর্যের গতিশীল পৃষ্ঠের অসাধারণ ছবি তুলছে।
সূর্যের গভীর পর্যবেক্ষণ
কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্ক মিশ একে একটি ফুটন্ত স্যুপের মতো বলেছেন, যেখানে সূর্যের কেন্দ্রে উৎপন্ন তাপ প্রবাহিত হয়ে পৃষ্ঠে উঠে আসে। যদিও তিনি গবেষণায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন না।
তার মতে, সানস্পটগুলো আসলে সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রের এমন জটিলতা বা “ম্যাগনেটিক প্লাগ”, যেগুলো তাপকে পৃষ্ঠে পৌঁছাতে বাধা দেয়। এ কারণে সানস্পটগুলো অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা ও গাঢ় দেখায়। যদিও তা পৃথিবীর যেকোনো চুলার চেয়ে বেশি উত্তপ্ত।
সূর্যের পৃষ্ঠে নানা ঘনত্ব ও তাপমাত্রার কারণে এর টেক্সচার বা বাহ্যিক গঠন আলাদা দেখা যায়, অনেকটা পেঁয়াজের মতো স্তরবিন্যাস রয়েছে এতে। এই স্তরগুলো পর্যবেক্ষণের জন্য VTF বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে “টিউন” করে ছবি তোলে, যা ব্যক্তিগত ক্যামেরার তুলনায় অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট।
এই যন্ত্রটি “ইমেজিং স্পেকট্রো-পোলারিমিটার” যা প্রতিটি তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলাদাভাবে ফিল্টার করে ছবি তোলে। এজন্য এটি ব্যবহার করে এক ধরনের এটালন, যা দুটি কাঁচের প্লেট দিয়ে তৈরি এবং যেগুলোর মাঝে অতি সূক্ষ্ম দূরত্ব থাকে।
ওয়োগার বলেন, “এটি অনেকটা নয়েজ-ক্যানসেলিং হেডফোনের মতো কাজ করে। একই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের দুটি তরঙ্গ একসাথে চললে একে অপরকে বাতিল করতে পারে বা শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে। দুই প্লেটের মাঝখানে আটকে থাকা আলো একে অপরের সঙ্গে হস্তক্ষেপ করে এবং নির্দিষ্ট দূরত্ব অনুযায়ী নির্দিষ্ট ‘রঙ’ পাস হয় বা বাতিল হয়ে যায়।”
মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই যন্ত্রটি শত শত ফিল্টার্ড ছবি তুলে তা একত্রিত করে একটি ৩-ডি চিত্র তৈরি করে।
এই চিত্রগুলো বিশ্লেষণ করে গবেষকরা সূর্যের বিভিন্ন স্তরে তাপমাত্রা, চাপ, গতি ও চৌম্বক ক্ষেত্রের গঠন সম্পর্কে জানতে পারেন।
ন্যাশনাল সোলার অবজারভেটরির সিনিয়র অপটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ড. স্টেসি সুওকা বলেন, “প্রথম স্পেকট্রাল স্ক্যানগুলো দেখা এক অবিশ্বাস্য মুহূর্ত ছিল। এটি এমন কিছু যা দূরবীক্ষণ যন্ত্রের অন্য কোনো যন্ত্র করতে পারে না।”
সামনে কী আসছে?
এই ইমেজিং স্পেকট্রো-পোলারিমিটার তৈরি করতে এক দশকের বেশি সময় লেগেছে।
NSF-এর জাতীয় সৌর অবজারভেটরিতে, মাউই দ্বীপের ১০,০০০ ফুট উঁচু আগ্নেয়গিরি হালেয়াকালার চূড়ায় অবস্থিত ইনোই টেলিস্কোপের একাধিক তলায় বিস্তৃত VTF।
জার্মানির ইনস্টিটিউট ফর সোলার ফিজিক্সে যন্ত্রটি ডিজাইন ও তৈরি করার পর, এটি আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে এনে সেখানে পুনরায় জোড়া লাগানো হয় — অনেকটা বোতলের ভেতরে জাহাজ তৈরির মতো কৌশলে।
গবেষক দল আশা করছে, ২০২৬ সালের মধ্যেই এই যন্ত্র পুরোপুরি কার্যকর হবে।
ইনস্টিটিউট ফর সোলার ফিজিক্সের প্রকল্প বিজ্ঞানী ড. ম্যাথিয়াস শুবার্ট বলেন, “এই প্রযুক্তির গুরুত্ব এতটাই যে বলা যায়, VTF-ই ইনোই টেলিস্কোপের হৃদস্পন্দন — এবং অবশেষে এটি তার চিরস্থায়ী ঠিকানায় স্পন্দিত হচ্ছে।”
এই টেলিস্কোপ ছাড়াও বিজ্ঞানীরা সূর্য ও এর ঝড়বিক্ষুব্ধ আবহাওয়া বোঝার জন্য আরও অনেক মিশনে কাজ করছেন, যেমন ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা ও NASA-র যৌথ প্রচেষ্টা ‘Solar Orbiter’ (২০২০ সালে উৎক্ষেপণ) এবং NASA-র ‘Parker Solar Probe’, যা সূর্যকে স্পর্শ করা প্রথম মহাকাশযান।