Your Ads Here 100x100 |
---|
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট এসেছে একটি পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বে থাকায় বাজেটের গাণিতিক হিসাব ছাড়াও কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের সুযোগ ছিল। কারণ সরাসরি নির্বাচনী চাপে নেই সরকার। কিন্তু দৃঢ়ভাবে গাঁথা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে সংস্কারের সম্ভাবনা সম্পৃক্ত, যা বড় ধরনের পরিবর্তনের জায়গাকে সংকুচিত করেছে।
বর্তমানে পরিস্থিতি এমন যে, রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে বিদ্যমান করদাতাদের চাপে না ফেলে। ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে জরুরি বিনিয়োগ থেকে পিছিয়ে আসাও চলবে না। আবার সামাজিক সেবা দিতে গিয়ে অবকাঠামো উন্নয়নকেও উপেক্ষা করা যাবে না। এসব পরস্পরবিরোধী অবস্থার মাঝে দাঁড়িয়ে বাজেটটি বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তনের তুলনায় সতর্ক পদক্ষেপের দিকে মনোযোগ দিয়েছে।
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কিছুটা হলেও এখনও দুর্বল। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৫.৫ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরের ৪ শতাংশের চেয়ে ভালো। তবে আইএমএফের ৬.৫ শতাংশ প্রত্যাশার চেয়ে অনেকটাই কম। মে মাসে ৯.০৫ শতাংশ থাকা মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ধরা হয়েছে, যা অনেকাংশেই নির্ভর করছে বৈশ্বিক পণ্যমূল্য ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনেকটাই নির্ভর করবে অর্থায়নের টেকসই কৌশলের ওপর, যেখানে দেশি-বিদেশি উভয় দিকেই রয়েছে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।
উচ্চাভিলাষী রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা, নিয়ন্ত্রিত ঘাটতি
২০২৫-২৬ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। চলতি অর্থবছরে ৪ লাখ কোটি টাকার সীমা অতিক্রম করা কঠিন হবে। আগামী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ৪০ শতাংশের বেশি রাজস্ব বাড়াতে হবে। সীমিত কর সংস্কার দিয়ে এই পরিমাণ রাজস্ব আদায় সম্ভব নয়। বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ কিছু উদ্ধার করতে পারলে সহায়ক হবে।
বাজেটের ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা সামষ্টিক অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য ঝুঁকির মধ্যে তুলনামূলক সহনীয়। এর মধ্যে ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা বিদেশি উৎস থেকে আসবে, যা উন্নয়ন প্রকল্প ও বাজেট সহায়তার মাধ্যমে আসার কথা। এতে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারি ঋণের চাপ কমার কথা। সে ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রাপ্তি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। তবে বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ার মানে হচ্ছে, ভবিষ্যতে বৈদেশিক মুদ্রা পরিশোধের দায় বেড়ে যাবে। অন্যদিকে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে তুলতে হবে। ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি খুব উল্লেখযোগ্য না হলে তখন আবার বেসরকারি ঋণ সংকোচনের আশঙ্কা তৈরি করবে। এই হিসাব থেকে দেখা যায়, ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার মোট ব্যয় রাজস্ব আদায় ও ঘাটতির যৌক্তিক সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ফলে বাজেট বাস্তবায়নে কাটছাঁট করা লাগতে পারে।
কর কাঠামোয় সাহসী পদক্ষেপ
রাজস্ব আয়ের বড় ভরসা কর ব্যবস্থা পুনর্গঠনে। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের প্রেক্ষাপটে এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশোধমূলক শুল্কনীতির ঝুঁকি মাথায় রেখে প্রত্যক্ষ করের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বাজেটে করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্যে আয়কর ফাইলিং প্রক্রিয়া সহজ করা; করমুক্ত আয়ের সীমা বৃদ্ধি ও উচ্চ আয়ের ক্ষেত্রে করহার সমন্বয়ের মতো কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী ৩০ জুন শেষে যে করছাড় সুবিধাগুলো শেষ হচ্ছে, সেগুলো পুনঃপ্রবর্তন করা হয়নি। তবে রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের জন্য বিশেষ হারে কর অব্যাহত রাখা হয়েছে, যা অন্যান্য খাতের সঙ্গে বৈষম্য সৃষ্টি করছে।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে কর কাঠামোয় কিছু উৎসাহ দেওয়া হলেও তালিকাভুক্তিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এখনও অন্যতম বাধা। অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগে ‘কঠোরতা’ আনা হয়েছে– করহার বাড়ানো হয়েছে ও প্রশ্ন না করার সুযোগ বাতিল করা হয়েছে। তবে এই সুবিধা পুরোপুরি বাতিল করা হয়নি, যা বিতর্কিত রয়ে গেছে।
ব্যয়ের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা, নতুনত্ব কম
সরকারি ব্যয়ের গঠনে বিশেষ পরিবর্তন নেই। বরাবরের মতোই মোট বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশ যাবে আবর্তক ব্যয়ে। মূলধন বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত রয়ে গেছে। কেবল ঋণ পরিশোধেই ব্যয় হবে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা, বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি ভাতা বাবদ বাড়তি ৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। বর্তমানে কেবল সুদ পরিশোধে ব্যয় হচ্ছে শিক্ষা, প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্য খাতের সম্মিলিত বরাদ্দের চেয়েও বেশি।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। বর্তমানে ১৪০টির বেশি প্রকল্প থাকলেও সংখ্যা কমিয়ে ১০০-এর নিচে আনা হবে এবং ৩৮টি প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, যেগুলো চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য। উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ বাড়বে, আর জনপ্রতি নগদ সহায়তা ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হবে। একই সঙ্গে প্রকৃত উপকারভোগী নির্ধারণে যাচাই-বাছাইয়ে জোর দেওয়া হবে। তবে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিশাল প্রয়োজনের তুলনায় এই বরাদ্দ যথেষ্ট নয়।
সবচেয়ে বড় পরিমাণ ভর্তুকি যাচ্ছে বিদ্যুৎ খাতে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়া ও টাকার অবমূল্যায়নের ফলে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাড়ছেই। কিন্তু ভর্তুকি হ্রাস ও কার্যকারিতা বাড়ানোর যে লক্ষ্য ছিল, তা এখনও বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে আছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এটি অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। নতুন মেগা প্রকল্প শুরু করার পথে হাঁটা হয়নি।
সংস্কারের পথে বাধা
অর্থনৈতিক সংস্কারের পথে কাঠামোগত বাধা রয়েছে। যেমন করনীতি ও প্রশাসনের বিভাজন প্রচেষ্টা প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। কর ব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন এগোচ্ছে ধীরগতিতে। অটোমেশন চালু হলে রাজস্ব সংগ্রহ সহজ ও দুর্নীতি কমে। কিন্তু প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও দক্ষতার অভাবে রাজস্ব ফাঁকির পথ খোলা রয়ে গেছে। এলডিসি থেকে উত্তরণ সামনে রেখে শুল্ক কাঠামো পুনর্বিন্যাসের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ ও জটিল হবে।
বাংলাদেশের রাজস্ব সংস্কার অনেক দিন ধরেই প্রাতিষ্ঠানিক জড়তা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও প্রভাবশালী অর্থনৈতিক মহলের প্রতিরোধের মুখে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে নতুন অর্থবছরের বাজেট এক পরিচিত দ্বৈত বাস্তবতা তুলে ধরছে। উচ্চাভিলাষী রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ও ব্যয় পরিকল্পনার পেছনে রয়েছে এক গভীর সংস্কার-অপ্রত্যাশী প্রশাসনিক কাঠামো। কাঠামোগত পরিবর্তনের দিকে যেতে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা সীমিত। তাই রাজস্ব প্রশাসনে বড় ধরনের পরিবর্তন না এলে এই বাজেট কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক অগ্রগতি এনে দিতে পারবে না।