28 C
Dhaka
শনিবার, জুন ২৮, ২০২৫

যুদ্ধের ভয়ংকর ১২ দিন

জনপ্রিয়
- Advertisement -
Your Ads Here
100x100

সত্যকে ধ্বংসের নাম যুদ্ধ; আবার মিথ্যার প্রতিবাদের নামও প্রতিরোধ যুদ্ধ। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, যুদ্ধ সভ্যতার মহাশত্রু। মানবজীবনের শত্রু। নির্বিচারে মানুষের রক্তের সাগর বানায় এই বিশ্বভূমিতে। সেই রক্ত ঝরানো যুদ্ধ দেখলাম ১২ দিনের। সাক্ষী হলাম নানা করুণ ইতিহাসের। দিনগুলো ছিল ভয়ংকর আর নিষ্ঠুর!

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ। ইসরায়েলের পক্ষে অংশ নিল যুক্তরাষ্ট্রও। আর ইরান– একা। বাকি বিশ্ব নীরব দর্শক।

কয়েক দিন ধরে সবার আলোচনার বিষয় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের পরমাণু বিষয় নিয়ে ধারাবাহিক বৈঠক। নির্ধারিত ছিল ১৫ জুন ষষ্ঠ দফায় আলোচনায় বসবে দুটি দেশ। তবে এর নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নানা হুমকি এবং ষড়যন্ত্রতত্ত্বও উড়ছিল বাতাসে! এসব নিয়ে ১২ জুন রাতে অফিস থেকে ফেরার পথে গাড়িতে থাকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা হয়। অনেকে বলছিলেন, কী হবে? যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান, ইসরায়েলের মতিগতি ভালো ঠেকছে না। খুবই অন্যমনস্কভাবে আমি বলেছিলাম– ইসরায়েল আজ রাতেই হামলা চালাতে পারে।

বাসায় ফেরার পর ঘুম আসছিল না। ইরানে এখন গরমকাল। মাঝেমধ্যে আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির সঙ্গে ঝড় ও মেঘের বিকট গর্জন শোনা যায়। ঘুম না আসা জ্বালা-ধরা চোখ কচলাতে থাকলাম। এমন সময় শুনতে পেলাম বিকট শব্দ, পরপর কয়েকবার। ভাবলাম, ভোরবেলায় এমন করে মেঘের গর্জন হচ্ছে কেন! ঝড় উঠবে নাকি? বারান্দার গাছগুলো নিয়ে ভাবনায় পড়লাম। তড়িঘড়ি উঠে বারান্দার দিকে দরজা খুলে বাইরে পা রাখতে যাচ্ছি, অমনি পৃথিবী কাঁপানো শব্দ। কেঁপে উঠল সবকিছু।

আমি তাল সামলিয়ে বারান্দায় পা রাখলাম। দেখতে পেলাম আকাশে তীব্র আলোর ঝলকানি। চিরচেনা বিদ্যুৎ চমকের ঝলকানি যেমন হয়, এটা তেমন নয়। বুঝতে সেকেন্ডও সময় লাগল না। আবার শব্দ, আর তা মেঘ ডাকার শব্দ নয়। নয় বিদ্যুতের আলোর চমকানিও। মনের মধ্যে ভয়ার্ত আর্তনাদ– এ যে হামলার শব্দ! আগ্রাসী আক্রমণের হুঙ্কার আর বিস্ফোরণের শব্দ! বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। সেই কথার অনুরণন হতে থাকল– ‘ইসরায়েল হামলা চালাতে পারে’। এ কি সেই হামলা!

এক-দুই মিনিট বারান্দায় বসে রইলাম। ভাবনা সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কোথায় কোথায় ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে– কী হচ্ছে এসব! তখন ধীরে ধীরে ভোরের অন্ধকার ফিকে হয়ে স্নিগ্ধ এক মায়াবী আলোর মুখ উঁকি দিচ্ছিল। পাখিরা সাধারণত ভোরবেলা ঘুম ভাঙার পর একটু কিচিরমিচির করে। আজও তার ব্যত্যয় ছিল না। কিন্তু সব পাখির সঙ্গে আজ কাকের কা-কা কর্কশ ডাকও শুনতে পেলাম। ভেতরটা আরও বেশি উৎকণ্ঠায় ভরে উঠল–
মহা কোনো অশনি নয় তো!

সকাল হতেই সেই উৎকণ্ঠা সত্যি প্রমাণ হলো। খবর এলো, চারদিক থেকে প্রিয় রাজধানী তেহরানসহ নাতাঞ্জ, ইস্পাহান, আরাক, তাবরিজ এবং আরও কিছু এলাকায় ইসরায়েল অতর্কিতে আগ্রাসী হামলা চালিয়ে সব শেষ করে দিয়ে গেছে। বেসামরিক মানুষ হত্যা করেছে; ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছে। সর্বোপরি আতঙ্কিত হওয়ার মতো তথ্য তখনই পেলাম– সামরিক বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সবাইকে হত্যা করেছে! গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠল; শরীরের মধ্যে যেন শক্তি হারিয়ে ফেললাম। এ কী হলো!

আমার বাসা বা অফিস থেকে খুব বেশি দূরে নয় তেহরানের যেসব জায়গায় ইসরায়েলি বাহিনী হামলা ও নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে গেল ভোররাতে! আমার বাসাটা গ্রিন জোনের মধ্যেই পড়ে। পশ্চিম তেহরানে; সরকারি বাসা। এ ভবনে বিশ্বের প্রায় সব মহাদেশের বিভিন্ন দেশের দুয়েকজন করে ২০টি সাংবাদিক পরিবার বাস করে। বেশ স্পর্শকাতর ভবন। তাই হামলাটা এখানেও হতে পারত। তাহলে বিশ্বের এতটি সাংবাদিক পরিবার আজ অন্তত রক্ষা পেয়েছে।

দ্রুত খবর সংগ্রহ করতে থাকলাম। সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানসহ সেনা কর্মকর্তাদের শহীদ হওয়ার খবর পেলাম। পরমাণু কেন্দ্রে হামলার খবরও। সবকিছু যেন থমকে গেছে! জানতে পারলাম, ইরানের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠক বসেছে। ইসরায়েলি হামলার ন্যায্য প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা চলছে।

ভীষণ মন খারাপ, অফিসে রওনা হলাম। ড্রাইভার অনেক কথা বলল। কিন্তু মন স্থির করতে পারছিলাম না। অন্যান্য দেশের সহকর্মীরাও ছিলেন। সবাই যেন হতবাক হয়ে গেলাম ইসরায়েলের হামলা ও হত্যাযজ্ঞে। আমার অফিসপাড়াও থমথমে আর গুমোট। আমার অফিসটাই ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থা। সব দেশি-বিদেশি সংবাদ এখান থেকেই আসে। কাজে মন বসাতে পারছিলাম না। বড় অস্থির লাগছিল। দুপুরে ক্যান্টিনে গিয়ে খেতে পারছিলাম না। সবকিছু যেন কেমন একটা তেতো মনে হচ্ছিল।

মাঝ দুপুরে মোটামুটি জানা গেল– গভীর প্রতিশোধ নেবে ইরান। অপেক্ষার পালা। বিকেল না গড়াতেই ইরানের শতাধিক ড্রোন উড়ে গেল ইসরায়েলের আকাশে। তাদের কড়া আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে বেশ কিছু আঘাত হানল তেল আবিবে। যুদ্ধ এবার শুরু।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। আকাশে সিঁদুরে মেঘ দেখতে পেলাম আমার ডেস্কে বসে, জানালা দিয়ে। কাজে মন বসাতে পারলাম না। সান্ধ্য বুলেটিনে যেতে হবে। রানডাউন রেডি করে স্টুডিওতে গেলাম স্থানীয় সময় বিকেল ৬টায়। ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলার বিপরীতে ইরানের প্রতিশোধমূলক অভিযানের খবর দিয়ে শুরু করলাম। সঙ্গে সঙ্গেই ইরানের সেনা কর্মকর্তাসহ শহীদদের খবর পড়লাম। স্টুডিওর পরিবেশ যেন ভারী হয়ে উঠেছে। এখানে ২২ বছরের কর্মজীবনে স্টুডিওতে ঠিক আজকের মতো এভাবে মহাযুদ্ধের খবর কখনও পড়তে হয়নি! খবর পড়ে ফিরে এলাম রেডিও বাংলার হাউসে। এক কাপ চা খেয়ে মনটা খানিক চাঙ্গা করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নানা ভাবনা এসে ভিড় জমাল মনের দুয়ারে। খবর পেলাম– রাতে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করবে।

রাতের হামলার কথা মাথায় নিয়ে বাসায় ফিরলাম। রাত তখন সাড়ে ১০টা। শুরু হলো ইরানের ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। ঝাঁকে ঝাঁকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুটে গেল ইরানের সেই সিঁদুর-রঙা আকাশের বুক ভেদ করে ইসরায়েলের দিকে। ভোর পর্যন্ত পাঁচটি ধাপে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানল ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবসহ বিভিন্ন অঞ্চলে। পাল্টা হামলার ফলে যুদ্ধটা পুরোমাত্রায় শুরু হলো। রাতে অবশ্য ইসরায়েলি পাল্টা হামলা তেমন লক্ষ্য করা গেল না। সকাল হতেই তেহরানের বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে ইসরায়েলি হামলা শুরু। বিস্ফোরণের শব্দে তেহরান কেঁপে উঠল। সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক যুদ্ধভীতি এবং আতঙ্ক। গোটা তেহরান যুদ্ধ আলোচনা এবং পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন পর্যন্ত এভাবেই চলল।

তৃতীয় দিনে যুদ্ধের যে ভয়ংকর রূপ, তা ফুটে উঠল। আতঙ্ক আর উদ্বেগ– এই বুঝি আমাদের ওপর ড্রোন হামলা হলো! বোমার বিস্ফোরণ ঘটবে! রাতভর তো ইরান প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ট্রু প্রমিজ-৩ এর আওতায়। ইসরায়েলও পাল্টা হামলা চালিয়েছে। তার বেশির ভাগই ছিল তেহরানে। মানুষ ধীরে ধীরে রাজধানী ছাড়তে শুরু করেছে।

দিন-রাত সে এক যন্ত্রণাদায়ক, বিভীষিকাময় অবস্থা। তখনও আমাদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত; স্বাভাবিক নিয়মের চেয়ে আরও খানিকটা কাজ বাড়ল। আমাদের কর্মস্থল জাতীয় সম্প্রচার সংস্থার সদরদপ্তর বিদেশিদের জন্য বিশ্বকার্যক্রমের ভবনে ইসরায়েল হামলার ঘোষণা দিল। তবুও আমরা অফিসে গেলাম। ১৫ জুন দুপুরে হঠাৎ ড্রোন বিস্ফোরণের শব্দ। আমাদের ভবনের অদূরে (সিজদাহ তাবাকে) একটি টেলিভিশন ভবনের খুব কাছেই বিস্ফোরণের শব্দ। ওই ভবনের সবাই বারান্দা কিংবা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। আমরাও আমাদের জানালায় দাঁড়িয়ে বিহ্বল হয়ে দেখছি। নির্দেশনা এলো ভবন ছেড়ে নিচে নেমে যাওয়ার। সবাই নিচে নেমে গেলাম। জানা গেল, ড্রোনটা এসেছিল ঠিকই, কিন্তু একে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইন্টারসেপ্ট করেছে। আকাশেই ধ্বংস করে দিয়েছে।

আমরা সবাই ঘণ্টাখানেক নিচে থেকে তারপর আবার ফিরে এলাম হাউসে; কাজে বসলাম। তবে ভেতরে একটা ভয়ের কাঁটা একটু একটু হুল ফুটাতে লাগল। ঘরে ফিরলাম। ভয়টা পিছু ছাড়ছিল না। রাত যত গভীর হতে থাকল, ইসরায়েলি ড্রোন হামলা, বোমার বিস্ফোরণ ঘুম হারাম করে দিল। শহরবাসী যারা তখনও ঘর ছাড়েনি, তাদের জেগে জেগে রাত কেটে গেল।

রাতের আঁধার কেটে সকাল হলে যেন একটু স্বস্তি। অন্তত আলোটাই যেন শক্তি জোগাল– যা কিছু হবে তা চোখের সামনে অন্তত, সেই ভরসাটুকু তো আছে। অথবা কোনো হামলা দেখলে দৌড়ে পালাবার অন্তত একটা পথ খোঁজা যাবে– এমন একটা সাহস বুকে জন্মাল। কিন্তু হামলাগুলো হচ্ছিল অনেকটা ঘোষণা দিয়ে এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে।

আগেও বলেছি, বেশির ভাগ হামলা হচ্ছিল তেহরানের অভ্যন্তর থেকে ইসরায়েলি এজেন্টদের মাধ্যমে। সেটাই যেন আরও বেশি ভয়ের কারণ। অফিসের কোনো ছুটি নেই, বরং যুদ্ধের খবরসহ সার্বিক বিষয়ের ওপর সবার দৃষ্টি রাখতে হচ্ছিল। এরপর এলো ১৬ জুন। এবার আর ইসরায়েল যেন ভুল করল না; সত্যিই ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থা আইআরআইবির সদরদপ্তরে ভয়াবহ হামলা হলো বিকেল পৌনে ৬টা নাগাদ। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল আমাদের সদরদপ্তরে। আকাশে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী উড়তে উড়তে বহু দূর পর্যন্ত ভয়ের রেখা তৈরি করল।

আমাদের সদরদপ্তরে হামলার মিনিট দশেক আগে আমরা খবর পেলাম, দ্রুত বিশ্ব কার্যক্রমের ভবন ত্যাগ করার। আমরা সহকর্মীরা যে যেভাবে ছিলাম, সেভাবে বেরিয়ে পড়লাম ছুটে ছয়তলা থেকে নিচে। তার পর দ্রুত হেঁটে প্রধান সড়কে। বিশ্ব কার্যক্রমের সব বিদেশি সাংবাদিক একই সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন। এর মধ্যে পরিস্থিতির ভয়াবহতায় আমাদের অফিস সার্ভিসের মেসেজ– আমাদের প্রধান গেট থেকে পিক করবেন চালক। আমরা তখন খানিকটা দূরে পার্কে মিল্লাতের কাছে একটা বিআরটি স্টপেজের কাছে। আমি আর এক সহকর্মী পরপর আসা দুটি বিআরটি পরিবহনে এক স্টপেজের সামনে আমাদের প্রধান গেটের কাছে যাওয়ার জন্য উঠেছি। বাসটি চলছে, এরই মধ্যে হামলা। চারদিকে মানুষের ছোটাছুটি শুরু। রাজধানীর প্রধান সড়কটি আমাদের অফিসের সামনে দিয়েই গেছে। ভালিয়াসর সড়কটিতে যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ। আর একটি মানুষও দেখা গেল না। পুরো এলাকা নিরাপত্তা বাহিনী সিল করে দিল। আমাদের বাসটি আর প্রধান গেটের সামনে দাঁড়াতে পারল না। একটু সামনে গিয়ে আতঙ্কিত প্যাসেঞ্জার সবাইকে নামিয়ে দিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। আমিও নেমে আমার জন্য অপেক্ষমাণ অফিসের ড্রাইভারকে ফোন দিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, চালক আমাকে রেখে ভয়ে দ্রুত গাড়ি নিয়ে চলে গেছে।

আমি তখন একা। আমার অফিসের প্রধান গেটের সামনে শত শত নিরাপত্তাকর্মী, রেড ক্রিসেন্ট, আইআরজিসিসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যের মধ্যে। পাশেই আইআরআইবির কেন্দ্রীয় ভবন জ্বলছে। সেখানে ইরানি সহকর্মীরা যারা ছিলেন, সবাই বের হতে পারেননি। যারা বের হতে পেরেছেন, তারাও অনেকে কাঁদছেন অন্য সহকর্মীর জন্য। আমার তখন নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে। বুকভরে শ্বাস নিতে হচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মাঝে দাঁড়িয়ে আমাদের কেন্দ্রীয় ভবনের দাউ দাউ করে জ্বলা আগুন দেখছি। চোখ দুটি কেবল ছুটে যাচ্ছে সেই আগুনের লেলিহান শিখার দিকে। কী করব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমাকে তখন দায়িত্বরত আইআরজিসির এক কর্মকর্তা বললেন, আপনি এই এলাকা ছেড়ে চলে যান। কিন্তু আমি কীভাবে যাব! সবকিছু সিল করে দেওয়া হয়েছে। রাস্তা বন্ধ, কোনো ধরনের পরিবহন নেই। সাধারণ মানুষ তো নেই-ই। সেনা কর্মকর্তাকে অনুরোধ জানালাম একটা ব্যবস্থা করার জন্য। তিনি তাঁর এক সহকারীকে ডেকে আমাকে একটু নিরাপদ দূরত্বে নামিয়ে দেওয়ার কথা বললেন। সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টার দিকে আমাকে একটা গাড়িতে মাইল তিনেক দূরে প্রধান সড়কে নামিয়ে দিয়ে তিনি চলেন গেলেন। ঠায় দাঁড়িয়ে আমি একা।

কোনো গাড়ি রাস্তায় চলছে না। দুয়েকটা এলেও তা বিদ্যুৎ গতিতে চলে যাচ্ছে, থামা দূরের কথা। খানিকক্ষণ একা দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটতে শুরু করলাম। কয়েক কিলোমিটার হাঁটার পর এক নারী পাশ কাটিয়ে সাঁ করে চলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখলাম, গাড়িটা থামালেন। আমি হাঁটতে হাঁটতে তাঁর পাশে গেলে বললেন, ‘কোথায় যাবেন?’ বললাম বাসার কথা। তিনি বললেন, ‘পাশের কোনো একটা মেট্রো স্টেশনে নামিয়ে দিতে পারি।’ সেটাইবা কম কী! আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। তাঁর কাছ থেকে একটু পানি নিয়ে খেলাম। মেট্রোতে ঘরে ফিরলাম রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে স্থির হয়ে বসার চেষ্টা। কিন্তু চোখে ভাসছিল আমাদের অফিসে আগুনের লেলিহান শিখা!

উদ্ধারকাজ চলতে থাকল পুরোদমে। একসময় আগুন নিয়ন্ত্রণে এলো। অনেকে আহত। তিনজনের মারা যাওয়ার খবর এলো। তারপর আমাদের পুরো কম্পাউন্ড সিল করে দেওয়া হয়। বাসা থেকেই কাজ করার নির্দেশনা। ওদিকে নেতানিয়াহু ও ট্রাম্প তেহরান খালি করার হুঁশিয়ারি দিলেন। ধীরে ধীরে তেহরান বলা চলে জনমানবশূন্য। হামলা-পাল্টা হামলা। ইরান দিনে-রাতে ইসরায়েলে সফল হামলা চালাতে লাগল। এতে ইসরায়েল অনেকটা কোণঠাসা। তবে তারা পাল্টা হামলা বন্ধ করেনি। রাতটা বেশি ভয়ের কারণ হয়ে উঠল। দুই চোখ এক করা সম্ভব হচ্ছিল না বিস্ফোরণের ভয়াবহ শব্দে। সন্ধ্যা নামার পর শুধু মনে হতো, কখন সকাল হবে! অনেকটা বসেই কেটে গেছে কয়েকটা রাত। আমার সরকারি বাসার প্রায় সব সহকর্মী নিরাপদ স্থানে চলে যায়। ভবনটিতে শুধু তিনটি পরিবার। তানজানিয়া ও কেনিয়ার দুটি পরিবারেরও চলে যাওয়ার কথা। কাজে ব্যস্ত থাকতাম আর আমার ছোট্ট বাগানে বসে থাকতাম। দেখতাম মাথার ওপর দিয়ে ড্রোন ছুটছে। কখনও বা ড্রোন ইন্টারসেপ্টের বিচ্ছুরিত আলো, কখনও বোমা বিস্ফোরণের ভয়াবহ শব্দ। প্রতিদিন মৃত্যু আর ধ্বংস বাড়তে থাকল তেহরান ও তেল আবিবে। এভাবে কেটে গেল যুদ্ধের ১০টি দিন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে আর পরিণতির কথা ভাবতে ভাবতে!

এর মধ্যে একদিন এক সহকর্মীসহ তেহরান থেকে ৫২ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি এক শান্ত গ্রামে গিয়েছিলাম আশ্রয়ের জন্য। সেখানে একটা রাত কাটিয়ে পরদিন তেহরানে বাসায় ফিরতে বাধ্য হই অফিসের কাজের জন্য। ১১তম রাতটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর মুহুর্মুহু হামলার শব্দ কানে আসে। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে তেহরানের পাঁচ অঞ্চলে (আমার বাসার এলাকা) হামলার ঘোষণা। বলা চলে, এখানে তেমন কোনো বাসিন্দা ছিল না। আমি আর ঘরে থাকাটা নিরাপদ মনে করলাম না। বেরিয়ে পড়লাম। পাশের বড় পার্কে গিয়ে গাছের নিচে একটা বেঞ্চে রাত কাটিয়ে দিলাম বিক্ষুব্ধ আকাশ যুদ্ধের ভয়ংকর শব্দ আর আলোর ঝলকানির মধ্যে। মনে হচ্ছিল, আর দেশে ফিরে যাওয়া হবে না!

রাতেই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালায়। তারা সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়ল ইসরায়েলের পক্ষে। সেদিন তেহরানের ভিন্ন এক রূপ চোখে পড়ল। প্রায় খালি হয়ে যাওয়া তেহরান যেন আবার মানুষে ভরে উঠতে লাগল। যখন মার্কিন হামলা হলো, আরও ভয়ের কারণ সৃষ্টি হলো; তখনই নগরের বাসিন্দারা ঘরে ফিরল। আর যেন কোনো ভয় নেই। শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে– এমন মনোভাব সবার মধ্যে। এদিকে আইআরজিসি জবাব দিল সন্ধ্যায় কাতারে মার্কিন সেনাঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে। তারপরই ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির ঘোষণা।

রাত ভোর হলো। সকালের আলোয় নতুন একটা দিন দেখতে পেলাম। মনে হলো, নতুন একটা জীবন পেলাম। ঘরে ফিরলাম। তখনও দুয়েকটা শব্দ কানে আসতে লাগল। আপাতত যুদ্ধ থামল। এভাবে কেটে গেল যুদ্ধের ১২টি দিন।

- Advertisement -spot_img
সর্বশেষ

আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে মৃত্যু আর ধ্বংসের দৃশ্যের মুখোমুখি হবেন খামেনি

অনলাইন ডেস্ক : ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ নেতা, ৮৬ বছর বয়সী আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি, ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত শুরুর পর থেকে...