খবরের দেশ ডেস্ক :
গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আদালত অবমাননার দায়ে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। তাঁর সঙ্গে গাইবান্ধার আওয়ামী লীগ নেতা মো. শাকিল আলম বুলবুলকে দুই মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাঁদের গ্রেপ্তার বা আত্মসমর্পণের দিন থেকে এই দণ্ড কার্যকর হবে।
প্রায় ১১ মাস আগে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর এই প্রথম কোনো অভিযোগে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সাজা হলো।
গতকাল বুধবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই রায় দেন। ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। এ মামলায় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম শুনানি করেন। শেখ হাসিনা ও বুলবুলের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমীর হোসেন।
আর অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ ওয়াই মশিউজ্জামানের বক্তব্য শোনেন ট্রাইব্যুনাল।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে সেদিনই ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। এর কিছুদিন পর থেকেই দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাঁর ফোনালাপের অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হতে থাকে। গত বছরের অক্টোবরে গাইবান্ধার আওয়ামী লীগ নেতা মো. শাকিল আলম বুলবুলের সঙ্গে শেখ হাসিনার একটি ফোনালাপের রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
যেখানে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার বিরুদ্ধে ২২৭টি মামলা হয়েছে, তাই ২২৭ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়ে গেছি।’
তদন্ত সংস্থার আবেদনে সিআইডি এই ফোনালাপের ফরেনসিক পরীক্ষা করে। প্রমাণ পাওয়ায় গত ৩০ এপ্রিল ফোনালাপটি ট্রাইব্যুনালের নজরে এনে শেখ হাসিনা ও শাকিল আলম বুলবুলের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার আবেদন করে প্রসিকিউশন। শুনানির পর ট্রাইব্যুনাল নোটিশ জারি করেন। এই ফোনালাপের কারণে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে কেন তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, সেই ব্যাখ্যা চান ট্রাইব্যুনাল।
গত ১৫ মে তাঁদের ব্যাখ্যা দাখিল করতে বলা হয়েছিল। সেদিন ব্যাখ্যা না পাওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাঁদের ২৫ মে সশরীরে হাজির হতে নির্দেশ দেন। ওই দিনও তাঁরা হাজির হননি। তখন ট্রাইব্যুনাল দুজনের বিষয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে নির্দেশ দেন। পরদিন দুটি সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে ট্রাইব্যুনালের আদেশ তুলে ধরে তাঁদের ৩ জুন সকাল ১০টায় হাজির হতে বলা হয়। সেদিনও তাঁরা ট্রাইব্যুনালে আসেননি। এমন পরিস্থিতিতে গত ১৯ জুন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ ওয়াই মশিউজ্জামানকে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে এবং শেখ হাসিনা ও বুলবুলের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী (স্টেট ডিফেন্স কাউন্সেল) হিসেবে আমিনুল গনি টিটুকে নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল। নিয়োগের পর রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমিনুল গনি টিটুকে নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। জুলাই আন্দোলনের আগে-পরে শেখ হাসিনার বিচার ও ফাঁসি দাবি করে ফেসবুকে দেওয়া তাঁর পোস্ট সামনে এনে অনেক প্রশ্ন তোলেন, যে আইনজীবী শেখ হাসিনার ফাঁসি চেয়েছেন, তিনি কিভাবে আদালতে শেখ হাসিনার পক্ষে দাঁড়াবেন? পেশাদারি, নৈতিকতা-নিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে গত ২৫ জুন শেখ হাসিনা ও বুলবুলের পক্ষে ট্রাইব্যুনালে শুনানি করতে দাঁড়ান আইনজীবী টিটু। তখন ট্রাইব্যুনালও তাঁর পেশাদারির নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির আবেদন করেন। আদালত তাঁর আবেদন মঞ্জুর করে শেখ হাসিনা ও বুলবুলের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে মো. আমীর হোসেনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
রায়ের পর চিফ প্রসিকিউটর সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালত সব পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনে এবং সিআইডির ফরেনসিক রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, এই ফোনালাপের মাধ্যমে শেখ হাসিনা তাঁর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার বাদী, সাক্ষী, তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের হত্যা, তাদের বাড়িঘড় জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩-এর ১১(৪) ধারা অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন প্রক্রিয়াকে প্রেজুডিস (বাধাগ্রস্ত) করার শামিল। এই অপরাধ চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ শেখ হাসিনা ও বুলবুলকে দণ্ড দিয়েছেন।’
এক প্রশ্নে মোহাম্মদ তাজুল বলেন, ‘ফোনালাপটি নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা প্রতিবেদন দিয়েছেন যে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে ভয় পাচ্ছেন। অনেকে মামলা করার জন্য এখানে (ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থায়) আসতে ভয় পাচ্ছেন। যেটা এই ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার শামিল।’
এ বিষয়ে অ্যামিকাস কিউরি এ ওয়াই মশিউজ্জামান ট্রাইব্যুনালে কী বক্তব্য দিয়েছেন, জানতে চাইলে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘তিনি বলেছেন এটা (ফোনালাপ) অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব জাস্টিসের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার শামিল। সুতরাং এটাতে আদালত অবমাননা হয়েছে বলে ইতিবাচক মতামত দিয়েছেন আদালতে।’
আরেক প্রশ্নে চিফ প্রসিকিউটর জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানা-আদালতে যে ২২৭টি মামলা হয়েছে, সেই সব মামলার বাদীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ২২৭টি মামলার মধ্যে অনেক মামলা স্থানান্তর করে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয়েছে। এর উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা মামলা ও রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যার মামলাগুলোর কথা উল্লেখ করেন।
এরপর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ভয় দেখানো হয়েছে। কিন্তু আমরা ভীত নই। আমরা কোনো কিছুতেই ভয় করছি না। আইন অনুযায়ী আমরা কাজ করব। ভীত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা কনসার্ন (উদ্বিগ্ন) সাক্ষীদের নিয়ে। এই (মানবতাবিরোধী অপরাধের) মামলা প্রমাণ করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সাক্ষী। সাক্ষীরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সাধারণ মানুষ। তা ছাড়া তদন্তকারী কর্মকর্তারাদের যদি ভয় দেখানো হয়, তাহলে মামলার তদন্তকাজে সেটির প্রভাব পড়বে। এ কারণেই আদালত অবমাননার অভিযোগের আবেদন করা হয়েছিল।’
রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমীর হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালত অবমাননার বিষয়ে প্রসিকিউশন শুধু একটি লিখিত কাগজ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেছে। এই লিখিত কাগজে যাঁরা স্বাক্ষর করেছেন, সেই স্বাক্ষরকারীরা যতক্ষণ পর্যন্ত আদালতে এসে সেটি এক্সিবিট (প্রদর্শন) না করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তা গ্রহণযোগ্য হবে না। তখন আদালত বলেছেন, এই প্রক্রিয়াটি ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যাই হোক, আমি রাষ্ট্রপক্ষের আনীত অভিযোগের সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করেছি।’ পূর্ণাঙ্গ রায় দেখে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান এই আইনজীবী।