27.3 C
Dhaka
বুধবার, জুলাই ১৬, ২০২৫

গণঅভ্যুত্থান জুলাই সনদ ও সাংস্কৃতিক পুনর্গঠন

জনপ্রিয়
- Advertisement -
Your Ads Here
100x100

গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে শুরুর দিকে আরবান-এলিট সোশ্যাল স্ফিয়ারের জনপ্রিয় ‘গঠন’ ও ‘পুনর্গঠন’ আলোচনা এখন ‘সংস্কার’ হিসেবে আবর্তিত হচ্ছে। সংস্কারের মধ্য দিয়ে গঠন ও পুনর্গঠন সাধিত হবে কিনা, তা এখনও পরিষ্কার না হলেও ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার প্রাক্কালে সবার জন্য স্বস্তিকর সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি বা সাংস্কৃতিক পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে।

গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ও অর্থবহ করে তুলতে চিন্তা ও স্বরের বৈচিত্র্য লালন ও ধারণ করে জীবন ও যাপনের অংশ করে নেওয়া, জনজীবনে ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে চলে আসা চিন্তা ও চর্চার সঙ্গে নতুন চিন্তা ও চর্চার সংযোগ তৈরির বন্দোবস্ত নির্মাণ প্রশ্নে কার কী অবস্থান, তা নির্ণয় করাও গুরুত্বপূর্ণ।

২. গোড়াপত্তনকাল থেকেই বেশ কিছু বিতর্ক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতির জাতিসত্তা প্রশ্নে ‘বাঙালি’ জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের সময় থেকেই বাংলাভাষীরা ‘প্রবল’ হিসেবে উপস্থিত। প্রবলভাবে ‘বাংলাদেশি’ হয়ে ওঠা নাগরিকদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিত্বশীল বেশ কয়েকটি বর্গ মনে করে, পাহাড়ে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির মানুষ ‘সন্ত্রাসী’। তারা বাংলাদেশ থেকে আলাদা হতে চায়। বৈচিত্র্যপূর্ণ ভাষা-সংস্কৃতির নাগরিকদের ব্যাপারে বাংলাদেশের নাগরিকদের চিন্তা-সংস্কৃতি-বোঝাপড়ার পার্থক্য ও বিরোধ কোনোভাবেই আশাবাদী হওয়ার মতো নয়। ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি, ভাষা-সংস্কৃতি প্রশ্নে, বমসহ সব প্রান্তিক জাতির সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়ন প্রশ্নে, জমি-জঙ্গল-ঝিরি ও বুনন প্রশ্নে মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত জুলাই ঘোষণা পূর্ণতা পাবে না, সর্বজনীন হবে না।

রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রারম্ভ থেকেই বিভিন্ন জাতিসত্তা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অধিকারী নাগরিকদের ‘বাঙালি’ সংস্কৃতিতে আত্তীকরণের যে অপচর্চা  শুরু করেছিল, সেই বিভাজন মিটিয়ে সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনের ব্যাপারে  অনাগ্রহ বা অক্ষমতা প্রকাশ পাচ্ছে অভ্যুত্থানের পরে ক্ষমতায়িত বর্গগুলোর মধ্যেও। ‘জুলাই সনদ’ রচিত হওয়ার আগে অল্প সময়ের মধ্যে এই প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য এখন পর্যন্ত সুদূরপরাহত।

৩. সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমপ্রধান দেশে মুসলমানদের মধ্যেই চিন্তা ও চর্চার বৈচিত্র্যসমেত যথেষ্ট ফারাক উপস্থিত। মুসলিমদেরই বিভিন্ন বর্গের মধ্যে চিন্তা ও চর্চার পার্থক্য সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বিরোধ থেকে সংঘাতে রূপান্তরিত হতে দেখা গেছে। ইসলাম ধর্মানুসারীদের মধ্যেও তরিকা, চর্চা ও যাপনের ক্ষেত্রে ‘প্রবল’ ও ‘প্রান্তিক’-এর লড়াই দৃশ্যমান হচ্ছে। এর কারণ খোদ ইসলামের মধ্যকার চিন্তা ও চর্চার সাংস্কৃতিক মতপার্থক্য। ধর্মের বিবেচনায় রাষ্ট্রের যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাদের নিজেদের মধ্যে চিন্তা-চর্চার পার্থক্য থেকে সংঘটিত সংঘাত নিরসনে কার্যকর কোনো চিন্তা ও পদ্ধতি হাজির না করে ‘জুলাই সনদ’ কীভাবে আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণের ঘোষণাপত্র হয়ে উঠতে পারে?

৪. গোড়াপত্তনের সময় চুক্তি ছিল নাগরিকদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক হবে ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু রাষ্ট্রের সেই চর্চা ও চরিত্র নিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে পরিচয় দেওয়া রাজনৈতিক বর্গগুলো থেকে জোরালো  বিরোধিতা স্পষ্ট। ‘সেক্যুলার’ চর্চাকে তারা মনে করছেন ধর্মহীনতা। সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দিয়ে ‘বহুত্ববাদী’ শব্দবন্ধ পুনঃস্থাপন করে চিন্তা ও চর্চার নতুন সংস্কৃতি হাজির করার প্রস্তাবনা দিলেও ইসলামিক বর্গের পক্ষ থেকে বহুত্ববাদের ব্যাপারে আপত্তি ইতোমধ্যে উত্থাপিত। অন্যদিকে সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দবন্ধের প্রতি নতুন-পুরোনো শক্তিশালী নাগরিক সমর্থনও সোশ্যাল স্ফিয়ারে দৃশ্যমান।

ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র স্বয়ং সংখ্যাগরিষ্ঠদের চর্চার অনুগামী হবে, নাকি রাষ্ট্র হবে নিরপেক্ষ– এ প্রশ্নে ঐকমত্যের ভিত্তিতে দিকনির্দেশনা ছাড়া ‘জুলাই সনদ’ কার্যকর করা কঠিন হয়ে যাবে।

৫. নারীর পোশাক, চলল-বলন, নারী ও বৈচিত্র্যপূর্ণ চিন্তার নাগরিকের অধিকার প্রশ্নটি নাগরিক পরিসরে অন্যতম বিতর্কের বিষয়। সংখ্যার হিসাবে বিশাল হলেও ‘নারী’ এখনও রাষ্ট্রের সবচেয়ে ‘প্রান্তিক’ নাগরিক হিসেবে গণ্য। সাম্প্রতিক বছরগুলো ধরে নারীর সঙ্গে সংঘটিত বিভিন্ন নিপীড়ন, নারী প্রশ্নে বিভিন্ন বর্গের অধিপতিশীল, আগ্রাসী ও অবমাননাকর বক্তব্য, অবস্থান নিয়ে রাষ্ট্রের ভূমিকা নিতান্ত মামুলি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে অর্থ ও ক্ষমতার জোরে।

অর্থনীতিতে নারীর অবদান, রাষ্ট্র ও সমাজে নারীর ভূমিকার মূল্যায়ন যথাযথ নয়। নারীর কাজ, চিন্তার যথাযথ প্রকাশ রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিফলিত হয় না। নারী প্রশ্নে নারীদের চেয়ে বেশি চিন্তিত থাকতে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন বর্গের পুরুষদের। নারীর সহযাত্রী হওয়ার চেয়ে নারীর প্রতি কর্তৃত্ব ফলানোতে আগ্রহী চিন্তার বিস্তার ও প্রকাশ জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আরও বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নারীর প্রতি বিদ্বেষ, অবহেলার যে চিন্তাকাঠামো রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে মজ্জাগত, তাকে আঘাত না করে যে সনদই আসুক, তা পুরোনো ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা ছাড়া অন্য কিছু হবে না।

৬. নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার এই ভূমিতে নদী ধ্বংস করে ফেলার সব আয়োজন সম্পন্ন। যাচ্ছেতাইভাবে বন ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। জলাশয়, খালবিল, নালা, পুকুর ভরাট করে ভূগর্ভস্থ পানির যথেচ্ছা ব্যবহারের কারণে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে। আবাদযোগ্য চাষের জমি কমে যাচ্ছে জনসংখ্যার চাপে। প্রকৃতি-পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে মানুষের যাপন, সংস্কৃতি। সংস্কৃতির সঙ্গে যাপন, যাপনের সঙ্গে ভূমির সম্পর্ক, সকল প্রাণের সহাবস্থান প্রশ্নে এই ভূখণ্ডের মানুষের বোঝাপড়ার অবস্থা বর্তমান সময়ে খুব শোচনীয়। প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক অভিযোজনের রূপকল্প এই সময়ের সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নগুলোর একটি। প্রাণ ও প্রকৃতি প্রশ্নে রাষ্ট্র এবং নাগরিকদের বোঝাপড়ার নতুন বিন্যাস ছাড়া আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণ অসম্ভব।

৭. রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী আকারে বাংলাদেশের যে স্বতন্ত্র ও বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ধারার বিকশিত হওয়ার সুযোগ ছিল; এমনকি একাত্তরে যে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ও প্রতিশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সে আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন কখনোই দেখা যায়নি। সংগত কারণেই মানুষের সাংস্কৃতিক বিকাশ নানাভাবে ব্যাহত হওয়ার কারণে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রূপান্তর ও বিকাশের সব পন্থা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।

চব্বিশের রক্তস্নাত জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক পুনর্গঠন, রূপান্তর এবং বিকাশের ধারা ও ধরন কেমন হতে পারে তা নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ এসেছিল আমাদের সামনে। বাংলাদেশের মতো একটি সাংস্কৃতিক যুদ্ধ-ময়দানে রাষ্ট্রের বহুত্ববাদী, গণতান্ত্রিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের সাংস্কৃতিক কাজ শুরু করার সম্ভাবনা তৈরি হলেও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি কোন দিকে– তা পাঠক মাত্রই জানেন।

সমাজ পরিবর্তনের কথা যারাই বলেন, তাদের কাছেই ‘সাংস্কৃতিক পুনর্গঠন’ এড়ানো যায় না– এমন এক বিবেচনা। সমাজের বিভিন্ন বর্গের রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়া ছাড়া সমাজ শক্তিশালী হয় না। লম্বা নিবর্তনমূলক সময়ে সমাজে এক ধরনের যোগাযোগ বৈকল্য তৈরি হয়েছিল। অন্যদিকে এই যোগাযোগ বৈকল্য সামাজিক বিভিন্ন বর্গের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছিল। সেই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণতা পাওয়ার আগেই বিভিন্ন বর্গের সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তির পারস্পরিক পূর্ণ বোঝাপড়া ছাড়াই গণঅভ্যুত্থান ঘটে গিয়েছে।

৮. পারস্পরিক পূর্ণ বোঝাপড়া ছাড়া বিভিন্ন নিয়ামকের স্বতঃস্ফূর্ততায় সংগঠিত গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন বর্গের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার যে শর্ত তৈরি হয়েছে, তার কারণে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আগামীর বাংলাদেশ গঠনের আলাপে ‘সাংস্কৃতিক পুনর্গঠন’ অনিবার্য বিষয় হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। এই জরুরি প্রশ্ন সামলাতে বিবেচনায় নিতে হচ্ছে জুলাইয়ের সর্বব্যাপী সাধিত গণঅভ্যুত্থানে কারা রাষ্ট্র ও সরকারে ক্ষমতায়িত হয়ে ‘প্রবল’ হিসেবে হাজির হয়েছে এবং বিভিন্ন ইস্যু বা বিতর্কে তারা কী বলছে।

বিভাজিত রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোর মধ্যে লম্বা নিবর্তনমূলক সময় পার করে বহুত্ববাদী, গণতান্ত্রিক এবং রূপান্তরকামী রাষ্ট্রব্যবস্থার লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক পুনর্গঠন যাত্রায় যাদের রাহবার বা পথপ্রদর্শক হিসেবে অভ্যুত্থানের পরে জাতি মেনে নিল, তাদের সক্ষমতা ও সদিচ্ছা বোঝার সময় প্রায় সমাগত। জরুরি ও সাম্প্রতিক প্রশ্নের যথার্থ মুসাবিদা করে রাহবাররা। এ যাত্রায় জাতিকে সে রাস্তায় হাঁটাতে সক্ষম হবে, নাকি পুরোনো ঘূর্ণাবর্তেই ঘুরপাক খাবে, তার উত্তর কি পাওয়া যাবে জুলাই সনদে?

নজির আমিন চৌধুরী জয়: জুলাই অভ্যুত্থানের সংগঠক এবং সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় সংসদ

- Advertisement -spot_img
সর্বশেষ

পায়ের বিশেষ যত্ন নেন রাশমিকা মান্দানা, খরচ মাত্র ৫০ টাকা!

বিনোদন ডেস্কঃ দক্ষিণী সুপারস্টার রাশমিকা মান্দানা ব্যস্ততম শিডিউলের মাঝেও নিজের যত্ন নিতে কখনোই পিছপা হন না। ‘পুষ্পা’ সিনেমার জনপ্রিয় নায়িকা...