বিখ্যাত লেখক ও ভাষাবিদ প্রফেসর নোয়াম চমস্কি ভাষা নিয়ে এক অসাধারণ তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। তার মতে, ভাষার ক্ষমতা মানুষের মস্তিষ্কের একটি বিশেষ ভৌত বৈশিষ্ট্যের ফল। এটি শেখার কোনো বিষয় নয়। যেমন হৃদপিণ্ড রক্ত পাম্প করে, তেমনই মস্তিষ্কের এই বিশেষ ক্ষমতা ভাষা সৃষ্টি করে। চমস্কি বলেন, মানুষ ছাড়া কোনো প্রাণীর মস্তিষ্কে এমন কোনো অঙ্গ নেই যা ভাষার জন্য বিশেষভাবে কাজ করে।
চমস্কির তত্ত্ব অনুযায়ী, ভাষার ক্ষমতা মানুষের সহজাত। আমরা যেমন জন্ম থেকে শ্বাস নিতে শিখি, তেমনি ভাষাও আমাদের ভেতর স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হয়। তবে এই তত্ত্ব অনেক বিজ্ঞানী, ভাষাবিদ এবং মনোবিদ মানেন না। তাদের মতে, মানুষ এবং অন্যান্য গ্রেট এইপদের মধ্যে জিনগত তফাৎ এত কম যে ভাষার ব্যবহার শেখানোর মাধ্যমে অন্য প্রাণীরাও ভাষা রপ্ত করতে পারে।
প্রজেক্ট নিম: ভাষার সীমাবদ্ধতা পরীক্ষা
চমস্কির তত্ত্বের বিরোধীরা তাদের বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য গবেষণায় নেমে পড়েন। এ রকম একটি গবেষণা ছিল ‘প্রজেক্ট নিম’। এটি পরিচালনা করেন আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকিয়াট্রি ও সাইকোলজির অধ্যাপক হার্বাট এস. টেরেস। গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল, মানুষের মতো একটি শিম্পাঞ্জিকে বড় করে তোলা এবং তাকে ভাষা শেখানো সম্ভব কিনা তা বোঝা। শিম্পাঞ্জির নাম নিম রাখা হয়েছিল নোয়াম চমস্কি র নামকে বিকৃত করেই।
নিম চিম্পস্কি এবং তার জীবন:
এই প্রকল্পে একটি শিশু শিম্পাঞ্জি, যার নাম দেওয়া হয় “নিম চিম্পস্কি”, তাকে একটি মানব পরিবারের সঙ্গে বড় করা হয়। নীচের ছবিটি তার। তার সঙ্গে অন্য মানব শিশুদের মতোই ব্যবহার করা হয় এবং তাকে সাইন ল্যাংগুয়েজ শেখানো হয়। ১২ বছর ধরে নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিম প্রায় ১২৫টি সাইন ল্যাংগুয়েজ শব্দ শিখতে সক্ষম হয়।
তবে গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল ছিল যে, শিখে নেওয়া শব্দ ব্যবহার করেও নিম কোনো বাক্য গঠন করতে পারে নি, ফলে নিজের কোনো স্বাধীন বক্তব্য প্রকাশ করতে পারেনি। সে শুধুমাত্র তার ট্রেনারকে নকল করতে শিখেছিল আর নিজের চাহিদার সংকেত দিতে পেরেছিল—যেমন খাবার চাই, খেলতে চাই, বিরক্ত লাগছে ইত্যাদি। গবেষকরা লক্ষ্য করেন যে নিম তার শিখে নেওয়া ভাষার মাধ্যমে নিজের শারীরিক প্রয়োজন ও ইচ্ছা যেমন ক্ষিদে, যৌনতা ইত্যাদি প্রকাশ করতে পারলেও কোনো গল্প বলা বা গভীর চিন্তার প্রকাশ করতে পারেনি।
প্রজেক্ট নিম-এর ব্যর্থতা চমস্কির তত্ত্বকে আংশিকভাবে সমর্থন করে। গবেষক টেরেস বলেন, “নিমের বলার কিছুই নেই। সে শুধু তার ইন্দ্রিয়ের চাহিদা প্রকাশ করেছে।” অর্থাৎ প্রশ্নটা থেকেই যায় —“কথা বলার ক্ষমতা থাকলেই কি সত্যিকারের বক্তব্য বা চিন্তার প্রকাশ সম্ভব?” চমস্কির মতে, মানুষের মস্তিষ্কের সেই বিশেষ ক্ষমতা যার জন্য মানুষ কথা বলতে পারে, সেই ক্ষমতা নেই বলে অন্য প্রাণী কখনোই ভাষার প্রকৃত ব্যবহার করতে পারবে না।
মানুষের গল্প বলার ক্ষমতা এবং সমাজের বর্তমান অবস্থা:
মানুষ এবং শিম্পাঞ্জির মধ্যে মূল পার্থক্য তাদের চিন্তা প্রকাশের ক্ষমতায়। একজন মানব শিশু প্রথমে তার ইচ্ছা এবং চাহিদা প্রকাশ করতে শিখলেও, তার সত্যিকারের বক্তব্য বা “গল্প” বলার ক্ষমতা আসে তার ব্যক্তিত্ব এবং বিবেক গড়ে ওঠার পর।
খ্যাতনামা মনোবিদ কার্লের মতে, “মনে কষ্ট ছাড়া কারও বিবেক তৈরি হয় না।” মানুষের গল্প বলার ক্ষমতা বা কোনও ঘটনাকে বর্ণনা করার ক্ষমতা তার অভিজ্ঞতা, কষ্ট, এবং সমাজে তার অবস্থান নিয়ে ভাবনার ফল।
কিন্তু বর্তমান সমাজে, বিশেষ করে প্রতিযোগিতার চাপে, অনেক শিশুই নিজের ভাব প্রকাশ করতে শেখার আগেই দমন হয়ে যায়। তারা নিমের মতোই শুধু নিজের চাহিদার কথা জানায়, কিন্তু তাদের জীবনে কোনো “গল্প” থাকে না। তাদের মানবিক বিকাশ আটকে যায়, এবং অন্যের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছাও হারিয়ে ফেলে।