- Advertisement -
Your Ads Here 100x100 |
---|
খবরের দেশ ডেস্ক :
কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তখন আমেরিকায় গিয়েছেন নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করবেন বলে। একসময় ক্লাস শুরু হলো। ক্লাসে ছাত্রসংখ্যা পনেরো। বিদেশি বলতে হুমায়ূন আহমেদ আর ইন্ডিয়ান এক মেয়ে। তবে ছাত্রদের মধ্যে একজন অন্ধ ছাত্রকে দেখে হুমায়ূন আহমেদ বেশ চমকে উঠলেন। সে তার ব্রেইল টাইপ রাইটার নিয়ে এসেছে।
ক্লাসে ঢুকেই সেই ছাত্র বিনীত ভঙ্গিতে বললেন- “আমি লেকচার টাইপ করব। খটখট শব্দ হবে, এ জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি।”
হুমায়ূন আহমেদ হতভম্ব। কারণ, অন্ধ ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে এটা তিনি জানতেন। কিন্তু থিওরিটিক্যাল কেমিস্ট্রিও যে কেউ পড়তে পারে সেটা তাঁর অজানা ছিল।
কোর্স টিচার মার্ক গর্ডন লেকচার শুরু করলেন। ক্লাসের ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেলো।
বক্তৃতার শেষে তিনি বললেন- “সহজ ব্যাপারগুলো নিয়ে আজ কথা বললাম, প্রথম ক্লাস তো তাই।”
হুমায়ুন আহমেদ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। কারণ, তিনি কিছুই বোঝেননি।
গর্ডন ব্যবহার করছেন গ্রুপ থিওরি, হুমায়ূন আহমেদ তখন যে গ্রুপ থিওরির কিছুই জানতেন না। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর পাশে বসে থাকা আমেরিকান ছাত্রটিকে বললেন- “তুমি কি কিছু বুঝতে পারলে?”
সেই ছাত্র বিস্মিত হয়ে বললেন- ‘কেন বুঝবো না, এসব তো খুবই প্রাথমিক ব্যাপার।”
এক সপ্তাহ চলে গেলো। হুমায়ূন আহমেদ ক্লাসে যান, মার্ক গর্ডনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
কিন্তু কিচ্ছু বুঝতে পারেন না। নিজের মেধা ও বুদ্ধির ওপর যে আস্থা ছিল একসময় তা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো!
দেখতে দেখতে মিড-টার্ম পরীক্ষা এসে গেলো। পরীক্ষার পর যে লজ্জার সম্মুখীন হতে হবে তা ভেবে বেশ শঙ্কিত তিনি।
গর্ডন যখন দেখবে বাংলাদেশের এই ছেলে পরীক্ষার খাতায় কিছুই লেখেনি, তখন তিনি কী ভাববেন? ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানই-বা কী ভাববেন?
অথচ এই চেয়ারম্যানকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সভাপতি প্রফেসর আলি নওয়াব হুমায়ূন আহমেদ প্রসঙ্গে একটি চিঠিতে লিখেছেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ যে অল্পসংখ্যক অসাধারণ মেধাবী ছাত্র তৈরি করেছে, হুমায়ূন আহমেদ তাদের অন্যতম।
কিন্তু এই অসাধারণ মেধাবী ছাত্রটি যখন শূন্য পাবেন, তখন কী হবে? যথারীতি মিড-টার্ম পরীক্ষা শুরু হলো।
হুমায়ুন আহমেদ দেখলেন, একটি প্রশ্নের অংশ বিশেষের উত্তর তিনি জানেন, আর কিছুই জানেন না।
অংশ বিশেষের উত্তর লেখার কোনো মানে হয় না। তিনি মাথা নিচু করে বসে রইলেন। এক ঘণ্টা পর সাদা খাতা জমা দিয়ে বের হয়ে এলেন।
পরদিন রেজাল্ট হলো, তিন জন পেয়েছেন এ, ছয়জন বি, বাকি সব সি। বাংলাদেশের হুমায়ূন আহমেদ পেয়েছেন শূন্য। আর সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে সেই অন্ধ ছাত্রটি!
মার্ক গর্ডন হুমায়ূন আহমেদকে ডেকে পাঠালেন। বিস্মিত গলায় বললেন- “ব্যাপারটা কী বলো তো?”
হুমায়ূন আহমেদ বললেন- “কোয়ান্টাম মেকানিক্সে আমার কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না। এই হায়ার লেভেলের কোর্স আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
গর্ডন বললেন- “বুঝতে পারছো না তাহলে ছেড়ে দিচ্ছো না কেন?” হুমায়ূন আহমেদের স্থির জবাব- “আমি ছাড়তে চাই না।”
গর্ডন আতঙ্কের সুরে বললেন- “তুমি বোকামি করছ। তোমার গ্রেড যদি খারাপ হয়, যদি গড় গ্রেড সি চলে আসে, তাহলে তোমাকে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যেতে হবে।”
হুমায়ুন আহমেদ আবারও স্থিরভাবে বললেন- “এই নিয়ম আমি জানি।” গর্ডন বললেন- “জেনেও তুমি এই কোর্সটা চালিয়ে যাবে?” হুমায়ূন আহমেদ আবারও বললেন- “হ্যাঁ, যাবো।”
গর্ডন খানিকটা বিরক্তি নিয়েই বললেন- “তুমি খুবই নির্বোধের মতো কথা বলছো।”
যথারীতি হুমায়ূন বললেন- “হয়তো বলছি। কিন্তু আমি কোর্সটা ছাড়বো না।”
গর্ডন কারণ জানতে চাইলেন।
হুমায়ূন আহমেদ তখন আগের মতোই দৃঢ় চিত্তে বললেন- “একজন অন্ধ ছাত্র যদি এই কোর্সে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেতে পারে, আমি পারবো না কেন? আমার তো চোখ আছে!”
প্রফেসর গর্ডন হেসে ফেললেন আর বললেন- “তুমি আবারও নির্বোধের মতো কথা বলছো।
সে অন্ধ হতে পারে, কিন্তু তার এই বিষয়ে চমৎকার ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। সে আগের কোর্স সবগুলো করেছে। তুমি করোনি। আমার উপদেশ শোনো, এই কোর্সটা ছেড়ে দাও।”
কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ শুনলেন না। নিজের সিদ্ধান্তেই অটল রইলেন। নিজে নিজে অঙ্ক শিখলেন। গ্রুপ থিওরি শিখলেন, অপারেটর অ্যালজেব্রা শিখলেন।
মানুষের অসাধ্য কিছু নেই এই প্রবাদটি সম্ভবত ভুল নয়। কারণ, একসময় অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, তিনি কোয়ান্টাম মেকানিক্স বুঝতে শুরু করেছেন।
এরপর যথাসময়ে ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেলো। পরদিন মার্ক গর্ডন একটি চিঠি লিখে হুমায়ূন আহমেদের মেইল বক্সে রেখে দিলেন।
টাইপ করা সেই চিঠির বিষয়বস্তু ছিল অনেকটা এরকম- ‘তুমি যদি আমার সঙ্গে থিওরিটিক্যাল কেমিস্ট্রিতে কাজ করো তাহলে আমি খুবই আনন্দিত হবো এবং তোমার জন্য আমি একটি ফেলোশিপ ব্যবস্থা করে দিবো। তোমাকে আর কষ্ট করে টিচিং অ্যাসিসটেন্টশিপ করতে হবে না।
একটি পরীক্ষা দিয়েই হুমায়ূন আহমেদ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচিত হয়ে গেলেন। সেই পরীক্ষায় তিনি কতো পেয়েছিলেন জানেন? শুনলে হয়তো অবাক হবেন। পেয়েছিলেন ১০০ তে ১০০!
এরপর হুমায়ূন আহমেদ দেশে ফিরে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রি পড়িয়েছেন।