- Advertisement -
Your Ads Here 100x100 |
---|
খবরের দেশ ডেস্ক :
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ নামক তরুন কিন্তু দারুণ সুসার বৃক্ষটি ছিয়াশি বছর ধরে আমাদের দেশ ও জাতিকে কত ছায়া, ফুল ও ফল দিয়ে চলেছেন; তিনি তাজা থাকতেই নিজ চোখে তা দেখেও যাচ্ছেন। এআমাদের এক বিরটি সৌভাগ্য।
কোটি কোটি মানুষের কথা এই ক্ষুদ্র লেখায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। শুধু আমার অংশটুকুর সামান্য কিছু বলি।
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যখন ঝাপিয়ে পড়েছিলাম, তখন জীবিত অবস্থায় যে ফিরে আসবো, তার সম্ভাবনা ছিল অতি ক্ষীণ।
আমার সহযোদ্ধারা প্রায় সবাই শহীদ হয়ে গেছেন।
স্বাধীনতার পরে ফিরে এসে দেখি আমার খাট-চৌকিসহ ঘর বাড়ী সব পাক বাহিনী ও তাদের বর্বর দালালরা ইট সিমেন্টের মেঝে পর্যন্ত খুঁড়ে নিয়ে চলে গেছে।
ঘুমানোর বিছানাতো দূরের কথা, সম্ভ্রম রক্ষার মত কাপড়ই নেই, খিদে মেটানোর খাবার নেই। নেই নেই মানে কিচ্ছু নেই।
অথচ এই পাগলটার অনেকগুলো চমৎকার বাঁশি, প্রচুর বইপত্র, ছবি আঁকার রং-তুলি-ইজেল, ম্যাজিকের বাহারি সব সরঞ্জাম…… কী না ছিল!
এভাবে তিলে তিলে মরে যাওয়ার চেয়ে পাক বাহিনীর একটা বুলেটে মরে যাওয়াইতো ভালো ছিল।
আত্মহত্যা করে নিজেকে নিজে অপমানওতো আর করতে পারি না। মরতে মরতে বেঁচে রইলাম।
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে আমি মারাত্মকভাবে আহত হই। সেই অবস্থায় সশস্ত্র যুদ্ধ করার শারিরীক সক্ষমতা হারাই। একটু সুস্থ্য হলে আমাকে নদীয়া জেলার বাহাদুর পুর ক্যাম্প স্কুলে শিক্ষক হিসেবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিছুদিনের মধ্যেই শিক্ষকতার কাজটি আমাকে দারুন তৃপ্তি দিতে শুরু করলো।
স্কুল-কলেজ জীবন থেকেই যেকোন কাজকে আনন্দদায়ক করে তোলার যোগ্যতা অর্জন করে ফেলেছিলাম। গল্প বলা, ম্যাজিক দেখানো, উপস্থিত বক্তৃতা, আবৃত্তি সবকিছুতেই সুন্দর করে কথা বলার দক্ষতা লাগতো। সঙ্গে ছিল আমার মোক্ষম অস্ত্র। কথা বলতে বলতে ব্লাকবোর্ডে অতিদ্রুত ছবি এঁকে ফেলার দক্ষতা।
বাহাদুর পুর ক্যাম্প স্কুলে আমার অসহায় ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে আমি যতটা না শিক্ষক তার চেয়ে বেশি বিনোদনদাতা। রাতারাতি আমি হয়ে গেলাম এক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা।
ঐ ক্যাম্পের কিছু স্মরণার্থী আমাদের সমুদয় কাঠী এলাকারও ছিলেন। তাঁরাই অতিউৎসাহী হয়ে অনুনয় করে আমাকে সমুদয় কাঠী হাই স্কুলে শিক্ষক হতে রাজি করলেন।
আমার থলেতে যত রকম আনন্দ বিনোদনের উপাদান ছিল সব ঢেলে প্রতিটি পিরিয়ডকে বিনোদনমূলক শিক্ষার অনুষ্ঠান করতে লাগলাম। আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা স্রোতের মত আমার স্কুলে এসে ভর্তি হতে শুরু করলো।
স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি জোর করে প্রথমে আমায় সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং বছরের মাখায় প্রধান শিক্ষক হতে বাধ্য করলো।
আশৈশব যেসমস্ত শিল্পের চর্চা করে এসেছি, উৎসাহ পেয়ে তা আরো বহুগুনে বাড়িয়ে দিলাম।
এই সুনাম গ্রাম থেকে থানা, মহকুমা হয়ে সমগ্র বরিশাল জেলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে।
এর পরে ঢাকাকে কেন্দ্র করে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার পরামর্শ আসতে শুরু হল।
হঠাৎ ১৯৭৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী একদল ডাকাত বাড়ীতে আগুন জ্বালিয়ে আবার আমার সবকিছু পুড়িয়ে ছাই করে দিলো। হায়!
এখন বাঁচবো কিভাবে? বাড়তি যন্ত্রনা হল থানা-পুলিশ-কোর্টএ ছোটাছুটি।
অন্যদিকে ঢাকা থেকে আমার কাছে টিভিতে জাদুপ্রদর্শনের আমন্ত্রণ জানিয়ে একের পর এক টেলিগ্রাম আসতে শুরু করলো।
পঞ্চম টেলিগ্রামটি এলে বরিশালের এক বন্ধু তা পড়ে বিস্মিত হয়ে বললো,
— আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সাহেবকে তুই চিনিস?
— না তো।
— সেই জন্যই তুই তাঁর এতগুলো টেলিগ্রামের পরেও কোনো হুঁস হয়নি।
তাঁর টিভি প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেলে মানুষের জীবন ধন্য হয়ে যায়।
— তোরাতো জানিস, আমার সব পুড়ে শেষ। আমি টিভিতে গিয়ে কি দেখাবো?
— তবুও তুই স্বশরীরে আজাই যাবি। অন্তত সৌজন্যের খাতিরে হলেও তুই গিয়ে ‘সরি’ বলে আসবি।
বন্ধুরা সবাই মিলে আমায় জোর করে লঞ্চে তুলে দিল।
ব্যাস। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এমনই শক্তিশালী চুম্বক, যাঁর স্পর্শে কেউ একবার গেলে আর ছুটে আসতে পারেনা।
প্রথম দেখাতেই তিনি আমাকে ভালোবেসে ফেললেন। আমার কোনো ম্যাজিক নাদেখেই তিনি আমাকে পুরোপুরি আস্থায় নিয়ে নিলেন। সামনেই বিটিভির ‘ঈদের আনন্দমেলা’।
তিনি অনেক ভেবেচিন্তে আমাকে ‘আনন্দমেলা’র ক্লোজিং পারফরমার হিসেবে রাখলেন।
ঈদের রাতে ‘আনন্দমেলা’ প্রচারিত হল।
আমার প্রদর্শিত ‘শুন্যে অসমান তরুনী’ টিভির অগনিত দর্শকদেরকে বিস্ময়ে হতবাক করে ফেললো।
রাতারাতি বিটিভি আমায় জাতীয় পর্যায়ের জনপ্রিয় শিল্পী বানিয়ে দিল।
কোনো অডিশন স্থাড়াই সায়ীদ স্যার আমাকে এতটা আস্থায় স্থান দিচ্ছেন বলে তাঁর মেধাবী সহকারীদের খুব সংশয় ছিল। এখন তাঁরাই আমার সেরা ভক্ত হয়ে গেল। তাঁদের মধ্যে
ডাঃ লিয়াকত আলী, ডাঃ আরিফ, মিজারুল কায়েস, খান লোদী, সুশীল সুত্রধরের কথা আমি জীবনেও ভুলবোনা।
টিভি প্রোগ্রামের পাশাপাশি আমার স্টেজ শোও জনপ্রিয় হয়ে উঠলো।
প্রতিটি স্টেজ শো এর দর্শক সারিতে বসে সায়ীদ স্যার নোট বই এ আমার ব্যক্তিত্ব, উপস্থাপন, কথা বলা, দর্শকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন……. ইত্যাদি বিষয়ে আরো ভালো কিভাবে করা যায় সেই পরামর্শ লিখে আমায় দিতেন। সে ছিল আমার জন্য এক মহার্ঘ্য উপহার।
বছর খানেকের মাথায় আমাদের চার-পাঁচ জনকে নিয়ে তিনি শুরু করলেন পাঠচক্র। প্রথম দিকে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সামনের রাস্তা পেরিয়ে একটা সস্তা ‘ভাতের হোটেলে’ বসতাম।
একখানা বই ভাগাভাগি করে পড়ে পরের সপ্তাহে যার যার নিজস্ব মতামত বলে আলোচনায় মেতে উঠতাম।
‘কণ্ঠস্বর’ ম্যাগাজিনের প্রাক্তন সফল সম্পাদক, বিপুল জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক একমাত্র আমি ছাড়া বাকী সবাই স্যারের সরাসরি ছাত্র।
স্যার সবার বিশ্লেষণ মনোযোগ সহকারে শুনতেন। সব মিলিয়ে যখন তিনি উপসংহার টানতেন তখন সবার মন আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতো।
ক্রমে আমাদের বসার একটা ছোট্ট ঠাঁই হল। ৩৭ ইন্দিরা রোড।
স্যারের দৃষ্টি সব সময় ভালো থেকে আরো ভালো, বড় থেকে আরো বড়। তাঁর দৃষ্টি বহুধা বিস্তৃত। সেই থেকে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সাথে আমার নাড়ীর বাঁধন কখনোই ছিন্ন হয়নি।
আমি দলবল নিয়ে সমগ্র দেশময় শো করে বেড়াচ্ছি। সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার ম্যাজিক হওয়ার কারণেই হয়তো দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের সাংবাদিকদেরও দৃষ্টিও আকর্ষিত হয়েছিল।
হঠাৎ ১৯৮১ সালে ‘সোসাইটি অফ আমেরিকান ম্যাজিলিয়ানস’ এর আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলাম ম্যাজিক দেখাতে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের কোনো ম্যাজিসিয়ানকে আন্তর্জাতিক ম্যাজিক সম্মেলনে দু’হাজার ম্যাজিসিয়ানের সামনে ‘আদর্শ পারফরমার’ হিসেবে ম্যাজিক দেখানোর ঘটনাকে আমাদের গ্রুপের সবার কাছে খুবই আনন্দদায়ক ও চিন্তাকর্ষক মনে হয়েছিল। তারচেয়েও বড় কথা আমেরিকার ঐ সম্মেলনে আমরা ‘আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ পেয়েছিলাম। বাংলাদেশের জন্য এ এক অবিশ্বাস্য রকমের সম্মান।
দারুণ উত্তেজনা নিয়ে দেশে ফিরছি। সম্মেলনে দেখানো আমাদের শো-এর একটি ভিডিও ক্যাসেট ‘সোসাইটি অফ আমেরিকান ম্যাজিসিয়ানস’ আমাদেরকে উপহার দিয়েছিল।
তখন বাংলাদেশে ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে আসা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে নিষিদ্ধ ছিল।
আমাদের আশা ছিল আমেরিকাতে কী ঘটেছিল টেলিভিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের দর্শক তা দেখুক। কিন্তু কাস্টমস্ কর্তৃপক্ষ কিছুতেই সেই ভিডিও ক্যাসেট আমাকে দিলনা।
প্রচন্ড আনন্দ নিয়ে দেশে ফিরছি। শুরুতেই খেলাম একটা বড় হোঁচট। মনমরা হয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে বের হলাম। গনগনে রোদ। বাইরে বেরিয়ে যা দেখলাম, আমার হৃদয়টা স্নিগ্ধ সুখে ভরে গেল।
আমাকে স্বাগত জানাতে আমার কোনো ম্যাজিসিয়ান বন্ধু এয়ারপোর্টে ছিল না, কিংবা ছিল না কোনো সাধারণ ভক্তও। কিন্তু যাঁদেরকে কখনো আশাই করিনি এমন একদল মানুষ রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে। হাতে তাঁদের ফুলের তোড়া এবং সুদীর্ঘ ফুলের মালা।
আমার গলায় যখন সেই কাঁঠালি চাঁপা ফুলের মালাগুলো পরিয়ে দেয়া হল তার বেশ কয়েকটিই আমার হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঝুলে পড়েছিল। বিষয়টি হয়তো হাসির। কিন্তু মোটেই হাস্যকর নয়।
যাঁরা আমাকে এয়ারপোর্টে সংবর্ধনা দিতে গিয়েছিলেন তাঁদেরকে আমি ঘুণাক্ষরেও আশা করিনি।
পুরো দলটাই ছিল সে সময়ের ক্ষুদ্র বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গোটাটি। বরং কিছু বেশিও। এঁদের নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তাঁর স্ত্রী এবং বাচ্চা মেয়ে লুনা ও জয়া, যাঁরা তখনো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেননা।
একসঙ্গে দল বেঁধে হাঁটছি। আর সেই দলের সামনে পেছন দিকে উল্টো হেঁটে ক্যামেরা চালাতে চালাতে ছুটছে সুশীল সুত্রধর। সবাই মিলে আমেরিকার অভিজ্ঞতার ব্যাপারে বৃষ্টির মতো প্রশ্ন করতে লাগলেন। আর আমিও এতদিন পরে আপনজনদের কাছে বলতে পেরে খুব আনন্দিত বোধ করছিলাম।
কিছুতেই যখন প্রশ্ন শেষ হচ্ছিলনা তখন সিদ্ধান্ত হল, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে (ইন্দিরা রোডস্থ) একটা আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।
সভা হয়েছিল। ঘন্টার পর ঘন্টা অসংখ্য বিষয়ে আলোচনা হল।
সে আনন্দ ভোলার নয়।
সেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র স্থানান্তরিত হয়ে চলে এল বাংলা মোটরের আজকের নিজস্ব স্থায়ী ঠিকানায়। ক্ষুদ্র একতলা পুরনো বাড়ী থেকে এখনকার সুরম্য অট্রালিকাই শুধু নয়, অনেকগুলো ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী, বই পড়া ও সেরা পাঠকদের পুরস্কৃত করার কর্মসূচির মত অসংখ্য দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য ডালপালা, শাখা প্রশাখা সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং আরো পড়তেই থাকবে।