কেমন ছিল জীবনানন্দ দাশ ও তাঁর স্ত্রী লাবণ্যর সম্পর্ক? যখন জীবনানন্দ দাশের বেশিরভাগ গল্প-উপন্যাসের ভরকেন্দ্র দাম্পত্য, তখন এই ধরনের প্রশ্ন প্রাসঙ্গিকতা পায় বৈকি। জীবনানন্দের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিনু সরকারের লেখায় পাই :
লাবণ্য দাশ, জীবনানন্দের স্ত্রীও আমার খুব কাছের মানুষ ছিলেন, তাঁর মুখে জীবনানন্দ সম্বন্ধে অনেক অভিযোগ শুনেছি। সেই অভিযোগ লাবণ্য দাশের দৃষ্টিকোণ থেকে যে খুব অযৌক্তিক তা আমার কখনও মনে হয়নি।… লাবণ্য দাশের সঙ্গে কথা বলে
বুঝতে আমার অসুবিধে হয়নি যে জীবনানন্দের বিবাহিত জীবন যেমন সুখের ছিল না, তেমন সুখের ছিল না লাবণ্য দাশের দাম্পত্য জীবনও।
জীবনানন্দ দাশের ভাইপো অমিতানন্দ দাশ লিখেছেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত ওঁদের দুজনের মধ্যে ভালো মনের মিল হয়নি— আর তার প্রতিফলন রয়েছে জীবনানন্দের কবিতার মধ্যে।’ জীবনানন্দের
ঘনিষ্ঠ বিরাম মুখোপাধ্যায়ের লেখায় দেখি :
নিজের বাসাতেই কবি থাকতেন নেহাত বহিরাগতের মতো। একদিন হঠাৎ আমায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, যদি স্ত্রী আপনার আমন্ত্রণে ঘনিষ্ঠ হবার প্রস্তাবে সায় না দেয় কী করবেন? কী করা উচিত? দাম্পত্য সম্পর্কের যে অস্বাভাবিকতার বীজ এই প্রশ্নটির মধ্যে রয়েছে সেই অস্বাভাবিকতা কবির পারিবারিক জীবনে লক্ষ্য করেছিলাম।
ভাবতে অবাক লাগে ৯ মে ১৯৩০ বিয়ের দিনই জীবনানন্দ দাশ ডায়েরিতে লিখছেন, ‘Difference between Labanya and Y : Y are reality— but Y lasts not’। লিখছেন, ‘যৌনতার নোংরা বাস্তবতার কথা’ লিখছেন, ‘আমার বিয়ে সবাই উপভোগ করছে এবং ঈর্ষান্বিত হচ্ছে— আর আমি?’ এমনকি এরকমও ভাবছেন, ‘একা বিছানায় শুয়ে নিজেকে ব্যাচেলার মনে করে নিলেই হল!’ তিনবছর পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৩৩-এ যে বিয়েটা ‘জঞ্জাল’ (our marriage is scrap) হয়ে যাবে বাসররাতেই তার শুরুটা হয়েছিল। বাসররাতকে বলছেন, ‘হীনাবস্থা’ (wretechedness), ১৯৪৭-এ পরিবার হয়ে দাঁড়াবে, ‘terrible suffocating prison’। অর্থাৎ ১৯৩০-এর ‘হীনাবস্থা’ ১৯৩৩-এ ‘জঞ্জাল’ হয়ে ১৯৪৭-এ পৌঁছে ‘ভয়ঙ্কর এক দমবন্ধ গরাদ’ হয়ে উঠল। বাসররাতের ‘অচেনা বিছানা’ (strange bed) সারাজীবন জীবনানন্দ দাশকে তাড়া করে
নভেম্বর ১৯৩১-এ লেখা ‘বিবাহিত জীবন’ গল্পে যেন জীবনানন্দ, লাবণ্য ও Y-কে নিয়ে যে জ্যামিতিক পরিসর তৈরি হয়েছিল তার সবটা ধরা আছে। ধরা আছে এই তিনজনের সম্পর্কের মধ্যেকার টানাপোড়েন, জটিলতা ও গোলকধাঁধা। অজিত বিয়ে করে স্ত্রী সুপ্রভাকে নিয়ে ফিরছে। শুরুতেই আমরা জেনে যাই ‘এই নারীসৌন্দর্য তাকে স্পর্শ করে না’, জেনে যাই সুপ্রভার সঙ্গে কথা বলবার ‘রুচি’ নেই তার। অজিতের দৃষ্টি কি সতীকে খুঁজছিল? যারা নববধূকে ‘স্ত্রীআচার’ ‘লোকাচার’ সেরে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল সেই ‘পাড়াপড়শিনী’র ভিড়ে সতীও তবে ছিল। লাবণ্য ও Y-এর মধ্যে
Y-ই তবে বাস্তব ! Y তথা Baby তথা শোভনা মজুমদার আমাকে বলেছিলেন, তিনি মিলুদার বিয়েতে যেতে পারেননি, ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছিল, বরিশালের ঘাটে গিয়েছিলেন নতুন বউকে বরণ করতে। আরও বলেছিলেন, মিলুদা বিয়ে করতে গেল কেন, মিলুদার বিয়ে করা উচিত হয়নি। আর কী আশ্চর্য, গল্পের সতীও ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্যই অজিতের বিয়েতে যেতে পারেনি। আমরা হতভম্ব হয়ে যাই
যখন দেখি অজিত ‘বিয়েবাড়ির, সমস্ত হুলস্থুলু টইটম্বুর হাত ছাড়িয়ে’ সতীর সঙ্গে ‘ওপরের ঘরে শেষ সীমানায় একটা অনাবিস্থিত কোঠায়’ গিয়ে বসে। অতঃপর কী কথা হয় তাদের মধ্যে? অজিত বলে,
‘বিয়ের পরেই কি সব অসত্য হয়ে যায়।’সতী উত্তরে বলে, ‘সে সব তামাশার কথা এখন আর বলো না’। সতী যখন বলে, ‘এখন তোমার অবহেলা করা চলে না।’ উত্তরে অজিত জানায় ‘নববধূর প্রতি এখনও
আমি কোনো প্রয়োজন বোধ করছি না’। বরং অজিত ভাবে সতী চলে গেলে ভোজবাজি ফুরিয়ে যাবে, ছেলেখেলার জাদুগুলি সতীই জানে, জীবনটাকে ঠেকাতে হলে জাদুর দরকার, দশ বারো দিনের জন্য নয় শুধু, সমস্ত জীবন ধরে। পাঠক হিসেবে আমাদের অস্বস্তি আরও বাড়ে যখন দেখি অজিত বলছে, ‘এই বিয়ে করবার আমার কোনো প্রয়োজন ছিল না’। তার উত্তরে সতী, ‘কেন করলে?’ এই ‘কেন’র উত্তরই জীবনানন্দকে বাকি জীবনটা খুঁজতে হয়েছে, কখনও গল্পে, কখনও উপন্যাসে, কখনও কবিতায়। এমন জীবনকে বাজি রেখে, এমন জীবন কোনও লেখককে ঘাড়ে ধরে লিখিয়ে নেয়নি।
আমার তো জীবনানন্দ দাশের অনেক গল্পে-উপন্যাস পড়তে পড়তে মনে হয় জীবনানন্দ লিখছেন নাকি চরিত্রেরা জীবনানন্দকে লিখছে। এমন গ্রস্ততা, ভূতে পাওয়া, ঘোর লাগা লেখক আমি খুব কম দেখেছি।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৩৩-এ লিখছেন, নিজের স্ত্রী সম্পর্কে :
এটা যে নিছক শিকড়হীন ভাবনা নয়, আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য ডায়েরি লেখার সময় ‘ডিসেম্বর’ ও ডায়েরির ‘শীতের রাত’ তা প্রমাণ করে। ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৩-এ স্ত্রী সম্পর্কে লিখছেন : The same old rejection… কথা বন্ধ… তুমি আমার কী benefit করেছ চার বছরের মধ্যে?… her great concern
and solicitudes for me step by step brought down to this callous negativity.
সত্যিই কী জীবনানন্দ এত ‘অনুভূতিহীন নঞর্থক’। আর ছয় মাস পরেই, মার্চ ১৯৩৪-এ তিনি ‘রূপসী বাংলা’ লিখবেন আর এক বছর নয় মাস আগে, জানুয়ারি ১৯৩২-এ লিখেছেন,
‘যেই ধান ছিঁড়ে যায় আজ রাতে— ডানা ভাঙে যে-ফড়িং— পাখি
তাহারা নিকটতর; পৃথিবীর বিধবারা ব্যথা পেয়ে এদের কুড়ায়
ভালােবাসে— গল্প বলে’।
ডায়েরিতে দাম্পত্যের এই ঘূর্ণিপাক বন্ধ হয় না। ৩১ অগস্ট ১৯৩৪-এ ডায়েরিতে জীবনানন্দ দাশ লিখছেন :
terrible অবস্থা for 3-4 days— দরজা বন্ধ, নাওয়া না, খাওয়া না, শুধু মুড়ি— দিনের পর দিন— কোনো অনুনয়-বিনয় কিচ্ছু না… will starve to death… এ বাড়ির সবাই তার পর… ওকে ভূতে পায় নাকি?
এই ভূতই মাল্যবান যখন ‘নেটের মশারি’ তুলে উৎপলার কাছে পৌঁছাতে চায়, প্রথম তাকে ‘বলির কুমড়ো’ তারপর ক্রমে ক্রমে ‘ডাকরা মিনসে’, ‘ইঁদুরে’, ‘ঘানির বলদ’ হয়ে শেষে ‘বেহায়া মড়া’ করে তোলে। আসলে জীবনানন্দের কাছে দাম্পত্য ‘বেহায়া মড়া’ই। কারুতান্ত্রিক জীবনানন্দ আজীবন এই ‘বেহায়া মড়া’র সাধনা করে গেছেন। তাই তো অগস্ট-সেপ্টেম্বর ‘প্রেতিনীর রূপকথা’য় লিখেছেন :
‘খোড়ো বনের ভিতর থেকে পাড়াগাঁর দুঃখিনী রূপমতীর উনুনের ধোঁয়া— পাশেই তার— বেল ও বাঁশের জঙ্গলের ভিতর থেকে ধূধূ মাঠের আনাচে-কানাচে যুগান্তের প্রেতিনীদের নিরবচ্ছিন্ন রূপকথা, কোথাও একটা চিতা, খানিকটা কাঠ মল্লিকার গন্ধ— আশশ্যাওড়ার জঙ্গলে জোনাকি, সজনে গাছের ডালে জোনাকি, লক্ষ্মীপ্যাঁচার ডাক; বাংলার মাঠঘাটের পথ দিয়ে অনেক শতাব্দী ঘুরিয়ে আনে আমাকে, প্রান্তর ও নিশুতির ফাঁক থেকে অসংখ্য মুখ উঁকি দেয়… বলে— চিনতে পার তো?’