26.5 C
Dhaka
মঙ্গলবার, জুলাই ২৯, ২০২৫

রাজধানীতে ঘরে ঘরে সর্দিজ্বর ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া একসঙ্গে

জনপ্রিয়
- Advertisement -
Your Ads Here
100x100
খবরের দেশ ডেস্কঃ

সারাদেশেই জ্বর, সর্দি-কাশির প্রকোপ মারাত্মক হারে বেড়েছে। ঘরে ঘরেই এখন রোগী। তীব্র জ্বরে শরীর কাবু করে ফেলায় অনেকে চিকিৎসা নিতে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটছেন। মশার প্রজনন মৌসুম চলায় অনেকে ডেঙ্গু মনে করে আরও বেশি আতঙ্কিত। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কারও চিকুনগুনিয়া, করোনাভাইরাস ও ডেঙ্গু ধরা পড়ছে। একই রকম উপসর্গ হওয়ায় চিকিৎসা দিতে সমস্যায় পড়ছেন চিকিৎসকরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, টাইফয়েড ও মৌসুমি জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে বেশির ভাগ মানুষ। চার থেকে পাঁচ দিনের জ্বর নিয়ে আসছেন রোগীরা। একজনের জ্বর হলে পরিবারের অন্যরাও জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। উপসর্গও প্রায় একই রকম। বেশি আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ ভাইরাস ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত জ্বরে। তাদের পরামর্শ, হালকা উপসর্গ দেখা দিলে আতঙ্কিত না হয়ে ঘরে বিশ্রাম নিতে হবে। পর্যাপ্ত পানি পান, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, মাস্ক পরা ও গরম তরল খাবার খেতে হবে।

রাজধানীর দুই হাসপাতালে তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি মাসের প্রথম ১২ দিনের তুলনায় পরের ১২ দিনে ১৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ রোগী বেশি চিকিৎসা নিয়েছেন। হঠাৎ রোগীর চাপ বাড়ায় হাসপাতালে বিভিন্ন ভাইরাসজনিত রোগ নির্ণায়ক কিটের সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া গত মাসের তুলনায় চলতি মাসে জ্বরের ওষুধের চাহিদা বেড়েছে ২৬ শতাংশ। এ সময়ে বেড়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সব রোগীর পরীক্ষা সরকারি হাসপাতালে না হওয়ার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিবন্ধন খাতার তথ্য বলছে, জুলাই মাসের প্রথম ১২ দিনে বহির্বিভাগে শুধু মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন সাত হাজার ১৮৪ জন। পরের ১২ দিন (১২ জুলাই থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত) চিকিৎসা নিয়েছেন আট হাজার ২৭৪ জন। সেই হিসাবে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর হার বেড়েছে ১৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ফারুক আহাম্মদ বলেন, আমরা দিনে গড়ে এক হাজার ২০০ রোগী দেখছি, যার একটি বড় অংশ ভাইরাস জ্বর, সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত। প্রায় সবারই জ্বর, কাশি, শরীর ব্যথা ও দুর্বলতা। রোগী সামলানো ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে সংকটে পড়ছি। জ্বর আসলে কোনো রোগ নয়, বরং এটি রোগের একটি লক্ষণ বা উপসর্গ। অনেকগুলো কারণে জ্বর হতে পারে। সবচেয়ে কমন হলো ঠান্ডা লেগে জ্বর হওয়া বা সর্দি-কাশির কারণে জ্বর। এর বাইরে শরীরের ভেতরে কোনো কারণে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের আক্রমণ হলে। অর্থাৎ ইনফেকশন হলে জ্বর হতে পারে। এ ছাড়া টিকা নিলে, ফোড়া বা টিউমার হলে, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, প্রস্রাবের রাস্তায় ইনফেকশন হলে, পিরিয়ডের কারণে, আকস্মিক ভয় পেলে বা মানসিক আঘাত পেলেও জ্বর হতে পারে।

ঢামেকের নিবন্ধন খাতার তথ্য বলছে, গত ১ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত এসব হাসপাতালে ৭৪ হাজার ২৮০টি বিভিন্ন ভাইরাস জ্বরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ১২ দিনে ৩৭ হাজার ৮৩টি পরীক্ষা করা হয়। এই ক’দিনে দিনপ্রতি গড়ে ৩ হাজার ৯০ জনের পরীক্ষা করা হয়। তবে পরবর্তী ১২ দিনে ৩৭ হাজার ১৯৭টি পরীক্ষা করা হয়। পরের ১২ দিনে দৈনিক ১১৪টি পরীক্ষা বেশি করা হয়েছে। এই ক’দিনে প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার ৯৯টি পরীক্ষা বেশি করা হয়। পরীক্ষার হার বেড়েছে প্রায় ০ দশমিক ৩১ শতাংশ। তবে এদের বাইরে অসংখ্য রোগী বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তাদের তথ্য পাওয়া যায়নি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্ট ও বিভাগীয় ইনচার্জ মাসুমা মন্নী বলেন, চিকিৎসা নেওয়ার সব রোগীর পরীক্ষা আমাদের হাসপাতালে হয় না। অনেক রোগী বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা করেন। সেই কারণে এর সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া জটিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষার চাহিদা বাড়ায় কিছু কিটের সংকট দেখা দিয়েছে। যে কারণে তিন মাস ধরে চিকুনগুনিয়া পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে।

ঢামেক হাসপাতালের ওষুধ স্টোরের তথ্য বলছে, গত জুনের চেয়ে চলতি জুলাইয়ে সবচেয়ে বেশি ওষুধের চাহিদা ছিল হিস্টাসিন। গত এক মাসে এই ওষুধের চাহিদা বেড়েছে ২০০ দশমিক ৩৩ শতাংশ। জুনে এই ওষুধ ঢাকা মেডিকেলে বিতরণ করা হয়েছে ছয় হাজার এবং জুলাইয়ে এসে এই ওষুধ বিতরণ করা হয়েছে ২০ হাজার। সাধারণত জ্বর প্রতিরোধে প্যারাসিটামল ওষুধ দেওয়া হয়। এই হাসপাতালে গত মাসের তুলনায় চলতি মাসে প্যারাসিটামলের চাহিদা বেড়েছে ২৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ। একইসঙ্গে প্যানটেক্স ওষুধ গত জুলাইয়ে বিতরণ করা হয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ২০০ পিস। জুলাইয়ে এই ওষুধের চাহিদা ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ বেড়ে বিতরণ হয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৯০০টি।

ঢামেকের সিনিয়র স্টোর অফিসার ডা. মেজবাউল হক বলেন, জ্বর-সর্দির ওষুধের চাহিদা বাড়লেও সংকট তৈরি হয়নি। নিয়মিত ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী প্রতি সপ্তাহে তালিকা দেওয়া হয়।

গতকাল সোমবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগ ঘুরে দেখা যায়, মেডিসিন, শিশু, চর্ম এবং নাক-কান-গলা বিভাগে রোগীর দীর্ঘ লাইন। অধিকাংশই জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা, শরীর ব্যথার উপসর্গ নিয়ে এসেছেন। অনেকে সকাল থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও সিরিয়াল পাননি।

বহির্বিভাগের সামনে কথা হয় কেরানীগঞ্জ থেকে আসা শাহীনুর আক্তারের (৩৫) সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার ছেলে চার দিন ধরে জ্বরে ভুগছে। স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা করালেও কোনো উন্নতি হয়নি। সকাল ৭টায় এসেছি, চার ঘণ্টা হয়ে গেল, এখনও ডাক পড়েনি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে কথা হয় গার্মেন্টকর্মী সালমা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, জ্বর, সর্দি নিয়ে আমি ও মেয়ে এসেছি। কিন্তু ভেতরে জায়গা নেই, বাইরে অপেক্ষা করছি। প্রাথমিক কিছু ওষুধও বাইরে থেকে কিনতে বলা হয়েছে।

চিকিৎসা নিতে আসা ফারুক হোসেন বলেন, আমার স্ত্রী জ্বর-কাশিতে আক্রান্ত। ঢাকা মেডিকেলে ওষুধ স্টোরে গেলে বলে, ওষুধ নেই। হাসপাতালে এসেও পরীক্ষা করতে বাইরে যেতে বলেছে। সব মিলিয়ে ভোগান্তি বেড়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন,
গত মাসের তুলনায় এবার রোগীর চাপ বেশি। ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু ও অন্য ভাইরাল সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। আমরা পরিস্থিতি সামাল দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কিট সংকটের তথ্য আমাদের কাছে নেই। ওষুধের চাহিদা বেশি, তবে আমাদের নিজস্ব ফার্মেসিতে সরবরাহ সীমিত।

মুগদা মেডিকেলের চিত্র 
একই অবস্থা রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, হাসপাতালের ১১ তলায় ডেঙ্গু রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। এখানে ৩৪ জন ভর্তি রয়েছেন। তাদের মধ্যে নারী ১৪ জন। এ ছাড়া আট তলায় শিশু বিভাগের ডেঙ্গু কর্নারে ১১ শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ১ জুলাই থেকে গতকাল পর্যন্ত এই হাসপাতালে এক হাজার ৫৪৫ জন ভর্তি হয়েছেন। প্রথম ১৪ দিনে এই হাসপাতালে ৭২৫ জন রোগী চিকিৎসা নেন। পরবর্তী ১৪ দিনে ৮২০ জন ভর্তি হন। অর্থাৎ রোগীর হার বেড়েছে প্রায় ১৩ দশমিক ৭০ শতাংশ।

 

অন্যদিকে, জুনে এই হাসপাতালে রোগীদের প্যারাসিটামল দেওয়া হয় ৩৫ হাজার পিস, প্যান্টিলোকাস ৭০ হাজার পিস এবং হিস্টাসিন তিন হাজার পিস। জুলাই মাসে প্যারাসিটামল এক লাখ ৩২ হাজার ৬০০ পিস, প্যান্টিলোকাস এক লাখ পিস এবং হিস্টাসিন পাঁচ হাজার ৫০০ পিস। গত মাসের চেয়ে এই মাসে প্যারাসিটামল দেওয়া বেড়েছে ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে তিন দিন ধরে এ হাসপাতালে ভর্তি আছেন বাসাবোর বাসিন্দা কামাল হোসেন। হাসপাতালে তাঁকে মশারির ভেতরে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। গায়ে জ্বরও আছে তাঁর। তিনি জানান, কয়েকদিন ধরে তীব্র জ্বর, প্রচণ্ড মাথাব্যথা, শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা নিয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা করান। এতে তার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। রক্তের প্লাটিলেটও কম। তাই জরুরি ভিত্তিতে ভর্তি হন। এখন অবস্থা আগের চেয়ে ভালো, প্লাটিলেটও বেড়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের এই গরম-ঠান্ডার মধ্যে প্রায় প্রতিটি পরিবারে মৌসুমি জ্বরের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। আবার বন্যাকবলিত এলাকায় পানিবাহিত রোগ বিশেষ করে টাইফয়েড, পেটের অসুখও হচ্ছে। এসব রোগীর একটু জটিলতা বেশি দেখা দিচ্ছে। এসব জ্বরে প্যারাসিটামল খেলেই হয়। কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের দরকার নেই।

তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির চিকুনগুনিয়ার চেয়ে গায়ে ব্যথা কম হয়। চিকুনগুনিয়ায় জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা হয়, মাংসপেশিতে অনেক বেশি ব্যথা হয়ে থাকে। গায়ে লালচে দাগ দেখা যায়। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, পাতলা পায়খানা হওয়া ও পেটে ব্যথা– এগুলো একটু বেশি দেখা যাচ্ছে।

মুগদা জেনারেল হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে আমরা যে উপসর্গগুলো দেখছি জ্বর, গলা ব্যথা, কাশি, দুর্বলতা– তা সাধারণ ভাইরাল সংক্রমণের সঙ্গে মিলে যায়। তবে একই সঙ্গে ডেঙ্গু ও ইনফ্লুয়েঞ্জার বিস্তারও দেখা যাচ্ছে। ফলে একাধিক ভাইরাস একসঙ্গে ছড়াচ্ছে বলে আমরা ধারণা করছি। অনেক রোগী চিকিৎসা নেওয়ার আগেই জটিলতা নিয়ে আসছেন, যা ঝুঁকিপূর্ণ।

তিনি আরও বলেন, ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তি সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। আমরা হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে চেষ্টা করছি, তবে জনগণকে মাস্ক ব্যবহার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং নিজ দায়িত্বে প্রাথমিক সতর্কতা মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছি। হালকা উপসর্গে আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

- Advertisement -spot_img
সর্বশেষ

তরুণীর প্রেমের টানে চীনা যুবক বাংলাদেশে

খবরের দেশ ডেস্কঃ টিকটকের মাধ্যমে প্রেম, আর সেই প্রেমের টানে চীনা যুবক সিতিয়ান জিং এসেছেন বাংলাদেশে। মাদারীপুরের খেয়াঘাটের মাঝির মেয়ে...