- Advertisement -
Your Ads Here 100x100 |
---|
খবরের দেশ ডেস্ক :
আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১) বাংলা সাহিত্যের এক বিদ্রোহী ও জটিল প্রতিভা। “চিরকুমার” পরিচয়ে খ্যাত এই সাহিত্যিক সারাজীবনই যেন এক টানটান দ্বন্দ্বে আবদ্ধ ছিলেন—সমাজের প্রতি ক্ষোভ আর ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার সংঘাতে। তাঁর জীবনের সবচেয়ে গভীর ও যন্ত্রণাদায়ক অধ্যায় জড়িত শামীম শিকদার নামের এক স্বাধীনচেতা নারীর সাথে। এই সম্পর্ক শুধু প্রেম নয়, ছিল মর্যাদাহানি, প্রকাশ্য প্রত্যাখ্যান এবং একটি ক্ষত যা ছফাকে আজীবন তাড়া করেছে।
ছফার দারিদ্র্য ও মানসিক সংকট:
ঢাকায় আসার পর ছফার জীবন ছিল চরম অনিশ্চয়তায় আবৃত। দিন কাটত অন্যের আশ্রয়ে—”আজ এখানে, কাল ওখানে”। পত্রিকায় অনুবাদ বা প্রুফ রিডিং-এর কাজ করে সাড়ে তিন আনা (প্রতি ফর্মা) উপার্জন দিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম (সূত্র: ছফার রচনা ও সৈয়দ আবুল মকসুদের গবেষণা)। এই দারিদ্র্য শুধু শারীরিক নয়, তৈরি করেছিল এক গভীর মানবিক ক্ষুধা—আশ্রয়, সান্নিধ্য ও নারীসঙ্গের আকুতি। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা থেকেই তিনি প্রায়শই নারীদের উদ্দেশ্যে “বিয়ের প্রস্তাব” দিয়ে বসতেন। মালেকা বেগম, সুরাইয়া খানমসহ অনেকে এতে বিব্রত হতেন, কিন্তু শামীম শিকদার ছিলেন ব্যতিক্রম।
শামীম শিকদার: এক ভিন্নধর্মী নারী:
শামীম শিকদার ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব। শহীদ ছাত্রনেতা সিরাজ শিকদারের বোন হিসেবে রাজনৈতিক সচেতনতায় ঋদ্ধ, আচরণে নির্মমভাবে সৎ ও স্বাধীনচেতা। তাঁর ডাকনামই ছিল “পান্ডা শামীম”—যা তাঁর বেপরোয়া, নির্ভীক স্বভাবের ইঙ্গিত দেয় (সূত্র: রবিন সাহার সাক্ষাৎকার)। ছফা বারবার স্বীকার করেছেন শামীমের প্রতি তাঁর “দুর্বলতা”র কথা, যা তাঁর আত্মজৈবনিক উপন্যাস “অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী”-এ “দূরদানা” চরিত্রে ফুটে উঠেছে। এই প্রেম ছিল মূলত একপাক্ষিক, কিন্তু শামীম ছফাকে পুরোপুরি ত্যাগ করেননি—এক ধরনের বন্ধুত্ব টিকিয়ে রেখেছিলেন।
আবুল কাসেম ফজলুল হকের বাড়ির নির্মম ঘটনা:
ছফা-শামীম সম্পর্কের সবচেয়ে মর্মান্তিক মুহূর্তটি ঘটে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক-এর বাড়িতে (সূত্র: ফজলুল হকের স্মৃতিকথা ও ছফার ঘনিষ্ঠদের বর্ণনা):
– ছফা শামীমকে নিয়ে হকের বাড়িতে গিয়ে ঘোষণা দেন- “আমরা বিয়ে করবো। শামীম আমাকে বিয়ে করতে চায়।”
ছফার আবেদন- বিয়ের পর হকের বাড়িতেই থাকতে চান (নিজের কোনো ঠিক না থাকায়)। হক রাজি হন, শর্ত দেন- “কাজী ডেকে এনে রেজিস্ট্রি করো, তারপর থাকবে।”
– ছফা কাজী আনতে যাওয়ার ফাঁকে শামীম হককে বলেন:
“বিষয়টা আমি মজা করেছি। ছফার সাথে বিয়ে করা যায় নাকি?! ও সবাইকে বলে বেড়ায় আমি নাকি তাকে বিয়ের জন্য পাগল… ওর ব্যক্তিত্ব বলতে কিছু আছে কি?”
– ছফার ফেরার পর শামীমের এই উক্তি শুনে তিনি মর্মান্তিক আঘাত পান। এই অপমান ও প্রত্যাখ্যান তাঁর জীবনে স্থায়ী দাগ কেটে যায়
জীবনব্যাপী ক্ষত ও সাহিত্যে প্রতিফলন:
এই ঘটনার পর ছফা আর কখনো বিয়ে বা গভীর প্রেমের কথা ভাবেননি। তবে শামীমের প্রতি তাঁর টান অব্যাহত থাকে, যা কবি অসীম সাহার স্মৃতিচারণায় স্পষ্ট (ছফা, স্মৃতিকথা”, পৃ. ৮৫):
একদিন সন্ধ্যায় ছফা আমাকে বললেন, “চল অসীম, শামীমের ওখানে যাই।”রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বললেন, “বুঝলে অসীম, আমি বোধহয় শামীমকে ভালবেসে ফেলেছি… কিন্তু ওকে আমি বিয়ে করব না।”আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?” ছফা জবাব দিলেন, “ও আমাকে মেরে ফেলবে!”
এই সংলাপে ছফার অন্তর্দ্বন্দ্ব ধরা পড়ে—আকর্ষণ ও ভয়ের সম্মিলন। শামীমকে তিনি ভালোবাসতেন, কিন্তু তাঁর স্বাধীনচেতা, আক্রমণাত্মক ব্যক্তিত্ব ছফাকে ভীতও করত। এই জটিলতা ছফার সাহিত্যে নারীর চিত্রায়ণে (যেমন: “গাভী বিত্তান্ত”) বারবার ফিরে এসেছে—নারীরা তাঁর কাছে ঈশ্বরী ও ধ্বংসকারীর দ্বৈত সত্তা।
শামীম শিকদারের সাথে ছফার সম্পর্ক শুধু ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়; এটি নারীর স্বাধীন ইচ্ছা ও পুরুষের দুর্বলতার এক নিষ্ঠুর দর্পণ। ছফার দারিদ্র্য, সামাজিক অসহিষ্ণুতা, এবং শামীমের নির্মম সততা মিলে তৈরি হয়েছিল এক অনিরাময় ক্ষত। কিন্তু এই বেদনাই তাঁকে গভীর মানবিকতাসম্পন্ন সাহিত্যিক করে তুলেছিল। ছফার জীবনের এই অধ্যায় আমাদের শেখায়: প্রত্যাখ্যানও সৃষ্টির শক্তি হতে পারে—যদি তাকে মেনে নেওয়ার সাহস থাকে। তিনি সেই সাহস দেখিয়েছিলেন, শামীম শিকদারের নাম চিরকাল তাঁর সাহিত্য ও স্মৃতির অংশ করে।