শাফিন আহমেদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ফিরে তাকাতে চাই মাইলসের শুরুর দিনগুলোতে। তখন ১৮ বছরের শাফিন আহমেদ কীভাবে এই ব্যান্ডে যুক্ত হয়েছিলেন।
সেই ১৯৭৮ সাল। সময়টা দেশের ব্যান্ডসংগীতের জন্য একরকম নিরীক্ষার। প্রাথমিক পর্যায়। হামিন আহমেদ, শাফিন আহমেদ, শাহিদুল, কমল আর নিনা মিলে একটা ব্যান্ড গড়েন। নাম দিয়েছিলেন ‘ব্যারাক’।
তবে শাফিনদের সেই যাত্রা বেশিদিন টিকল না। কমল আর নিনা বিদেশ চলে গেল। ভেঙে গেল ব্যারাক।
এর পরের বছর, ১৯৭৯ সাল। ষাটের দশকের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘লাইটনিংস’-এর ভোকাল ও বেইস গিটারিস্ট ফরিদ রশিদ নতুন দিনের জোয়ারে পা বাড়ালেন। গড়ে তুললেন এক ঝাঁক তুখোড় মিউজিশিয়ান নিয়ে নতুন ব্যান্ড, ‘মাইলস’।
হ্যাপি আখন্দ, রবিন, কামাল মঈন, ল্যারি, মুসা, ইশতিয়াক। মাইলস সেই সময়ে সুপার লাইনআপের ব্যান্ড। মুক্তিযুদ্ধের আগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের চ্যাম্বিলি রুমে যেমন আইওলাইটস(উইন্ডি সাইড অফ কেয়ার),লাইটেনিংস,র্যাম্বলিং স্টোনরা পারফর্ম করতেন। মাইলসও তখন সেই চাম্বেলিতে নিয়মিত বাজাতে শুরু করলো।
আজম খানদের হাত ধরে তখন শহরে ধীরে ধীরে গজিয়ে উঠছিল এক নতুন মিউজিক কালচার। নতুন সাউন্ডস্কেপ। ঠিক এই সময়েই একদিন মাইলসের মুসার বাসায় গিয়েছিলেন কিশোর হামিন আহমেদ। সেই বাসাতে তাঁরা প্র্যাকটিসও করতেন। ওই বাসায়ই হঠাৎ দেখা হয়ে যায় ফরিদ রশিদ আর হামিনের।
পরিচয় পর্বে হামিন জানালেন, তিনি ও তাঁর ছোট ভাই শাফিনের ব্যান্ড আছে । ফরিদ রশিদের আগ্রহ জন্মায়। আর কেন-ই বা জন্মাবে না! এই দুই তো নজরুলসংগীতের দুই কিংবদন্তি কমল দাশগুপ্ত আর ফিরোজা বেগমের সন্তান। ছোট থেকেই বড় হয়েছেন সাংগীতিক আবহে।
ফরিদ রশিদ সেদিন শাফিন-হামিনদের৷ ব্যান্ডের প্র্যাকটিস দেখতে চেয়েছিলেন। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই দৃশ্য, ধানমন্ডি ২৮ নম্বরের বাসায় প্র্যাকটিস চলছে। হামিন আর শাফিন গাইছেন-বাজাচ্ছেন, ড্রামসে আছেন নাইদার। ফরিদ রশিদ বসে শুনছেন গভীর মনোযোগে। ভালোও লেগে যায়।
এরপরই ডাক আসে হামিন আহমেদের। ফরিদ রশিদ জানালেন, মাইলসে তাঁকে দরকার। হামিন সানন্দে যোগ দেন, ভোকাল ও গিটারিস্ট হিসেবে।
মাইলস তখনো নিজেদের পথ খুঁজছে। কিছুদিনের মধ্যেই মুসা আর ল্যারি বিদেশে চলে যান। ফরিদ রশিদ নতুন মুখ খুঁজছেন। তখনই হামিন আহমেদ শাফিনের কথা বলেন। ফরিদ রশিদ রাজি হয়ে গেলেন। সেটাই তো স্বাভাবিক!
মাইলস পেলো নতুন ভোকাল আর গিটারিস্ট। আর এভাবেই শুরু হলো শাফিন আহমেদের মাইলস-যাত্রা। তখনকার লাইনআপ ছিল বাংলাদেশের প্রথম গিটার সেনসেশন হ্যাপি আখন্দ, রবিন, ফরিদ রশিদ, কামাল মঈন, ইশতিয়াক, হামিন আহমেদ আর শাফিন আহমেদ।
দুই ভাইয়ের উপস্থিতি যেন এক নতুন প্রাণ দিল ব্যান্ডটিকে। দু’মাসে তারা করে ফেলল বেশ কিছু শো। কিন্তু ব্যান্ড মানেই তো আসা-যাওয়ার গল্প। রবিন বিদেশে চলে গেলেন। ইশতিয়াক ব্যস্ততায় সময় দিতে পারলেন না।
এরপর কিছুটা বিরতি, আর তারপর আবার নতুন সময়। শাফিনও কিছুদিনের মধ্যেই পড়াশোনার জন্য দেশ ছাড়লেন। মাইলস ১৯৮২ আর ১৯৮৬ সালে দুইটা ইংরেজি গানের অ্যালবাম করলো। অরিজিনাল গান, কাভার দুই রকই ছিলো। বিদেশে বসে শাফিন কয়েকটা গানে ভোকাল দিয়েছিলেন।
১৯৯০ সাল। লেখাপড়া শেষ করে শাফিন আহমেদ স্থায়ীভাবে দেশে ফিরলেন। গিটার বাদ দিয়ে এবার হাতে নিলেন বেইস গিটার। তখনকার মাইলসে ছিলেন হামিন, শাফিন, মানাম আহমেদ আর ড্রামসে মিল্টন আকবর।
এই লাইনআপেই মাইলস ঢুকে পড়ে স্টুডিওতে। প্রস্তুতি নিতে থাকে তাদের প্রথম বাংলা অ্যালবামের জন্য। কারণ তখন মাইলসকে নিয়ে চলছিল সমালোচনা, তারা কেন শুধু ইংরেজি গান গায়!
জবাব এলো সুরে। ১৯৯১ সালে প্রকাশ পেল মাইলসের প্রথম বাংলা অ্যালবাম, ‘প্রতিশ্রুতি’। সেই অ্যালবামের গানগুলো যেন রাতারাতি সবার কানে ঢুকে পড়ল। এরপরের ঘটনা সবার জানা। দিনে দিনে মাইলস হয়ে উঠল সময়ের প্রতিনিধি। বাংলাদেশ কিংবা কলকাতা, সবখানেই জনপ্রিয় হয়ে উঠলো।
আজ আর না।