খবরের দেশ ডেস্ক :
সাংবাদিক ও কলামিস্ট আনিস আলমগীর বলেছেন, সাংবাদিকতা শুধুই সাহসিকতার পেশা নয়—এটি বিবেচনার, নীতির, এবং পেশাদার জ্ঞানের পেশা। বিশেষ করে সংঘাত বা অপরাধ সংশ্লিষ্ট রিপোর্টিংয়ে, সাংবাদিকের প্রধান অস্ত্র শুধু তার কলম বা ক্যামেরা নয়—তার নিরাপত্তাবোধ এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দক্ষতা। নিজের যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের অভিজ্ঞতা থেকে ভাবছি এটা নিয়ে সবার উদ্দেশে কিছু বলা দরকার, বিশেষ করে আমার যেসব তরুণ সাংবাদিক ভাইয়েরা মাঠে কাজ করছেন।
শুক্রবার রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে তিনি আরো বলেন, একজন সাংবাদিক, যে সত্য উদঘাটনের প্রয়াসে মাঠে নামেন, তার জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে সেই সত্য হয়তো আর কেউ জানতেই পারবে না।
‘দ্য ফাস্ট রুল অব জার্নালিজম ইজ : স্টে অ্যালাইভ। নো স্টোরি ইজ ওর্থ ডায়িং ফর।’- ইন্টারন্যাশনাল নিউজ সেফটি ইনস্টিটউট (আইএনএসআই)।
তিনি বলেন, ‘গাজীপুরের সাংবাদিক তুহিনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে আজ মাসুদ কামাল ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তার অন্য মঞ্চ টক শোতে।
তখনো হত্যার কারণ জানতাম না। পরে পুলিশ সূত্রে জানলা— এক চক্র এক নারীকে দিয়ে হানি ট্র্যাপ ব্যবসা করত। এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে গোলযোগে তারা তাকে প্রকাশ্যে কোপাতে থাকে। এই দৃশ্য তুহিন ভিডিও করছিলেন।
তার ফলস্বরূপ তাকেও কুপিয়ে হত্যা করে সেই চক্র। তুহিন সাহসী ছিলেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই সাহস কি সাংবাদিকতার প্রয়োজনে ছিল, নাকি তা বিপজ্জনক বোকামিতে পরিণত হয়েছে—এটা ভাবাচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সাংবাদিকতা তথ্য সংগ্রহের পেশা, আত্মাহুতি দেওয়ার নয়। ‘বি ব্রেভ, বাট নট ফুলিশ।
’—এটাই সাংবাদিকতার বাস্তব শিক্ষা। যেখানে কেউ প্রকাশ্যে কাউকে কুপাচ্ছে, সেখানে দাঁড়িয়ে ভিডিও তোলা যে জীবনঘাতী ঝুঁকি, এটা বোঝার জন্য সাংবাদিক হওয়ারও দরকার পড়ে না—প্রয়োজন কমনসেন্স এবং পেশাগত প্রস্তুতি। তাৎক্ষণিক বুদ্ধি। জানাজানির পর, তুহিন এই অপরাধী চক্রের সঙ্গে আপস করতে ব্যর্থ হয়েছে।’
আনিস আলমগীর বলেন, “সাংবাদিকতার নীতিমালায় কী বলা আছে? বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত সাংবাদিকতার নীতিমালায় (যেমন : এসপিজে কোড অব এথিক্স, আইএফজে গাইডলাইনস) স্পষ্টভাবে বলা আছে : ‘মিনিমাইজ হারম’–সংবাদ সংগ্রহের সময় সাংবাদিকের প্রথম দায়িত্ব নিজের এবং অন্যদের ক্ষতি কমানো। নিজের জীবন সুরক্ষিত রাখা নৈতিক ও পেশাগত কর্তব্য। ‘অ্যাক্ট ইনডিপেন্ডডেন্টলি, বাট রেসপনসিবলি’-সত্য প্রকাশের চেয়ে আগে আসে দায়িত্বশীলতা। ‘সিক ট্রুথ অ্যান্ড রিপোর্ট ইট’—সত্য উদঘাটন করো, তবে সেটি এমনভাবে করো যেন নিজের ও উৎসদের ক্ষতি না হয়। একজন সাংবাদিকের কোনো রিপোর্ট, ছবি বা ভিডিও তখনই মূল্যবান, যদি সে বেঁচে থাকে সেটা প্রকাশ করার জন্য। নিজের জীবনকে মর্যাদা না দিলে রিপোর্টও অর্থহীন হয়ে পড়ে।”
তিনি বলেন, ‘উন্নত দেশে হলেও এমন ভিডিও তুহিনের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করত। হত্যাকারীরা হয়তো পরে গোপনে প্রতিশোধ নিত, কিন্তু ড. ইউনূসের শাসনে বাংলাদেশে তা প্রকাশ্যেই ঘটছে। আইন-শৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই। আর এই দৃশ্য আমাদের কাছে এখন যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মুখে কোনো বিকার নেই। কিভাবে তিনি এখনো সেই পদে আছেন, সেটা এক বিস্ময়। তার পুলিশ ৫ জনকে ধরেছে কিন্তু হত্যাকারী আসামিদের একজনকে ধরতে পারেনি এখনো। শুরু করবে এখন অজ্ঞাতনামা লিস্ট দিয়ে মামলা বাণিজ্য।’
তিনি বলেন, ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত কুপিয়ে ও পিটিয়ে ১৭৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। সর্বশেষ ঘটনাগুলো যুক্ত করলে সংখ্যাটা কোথায় দাঁড়ায়, একটু হিসাব করলেই আঁতকে উঠতে হয়। টিআইবির হিসেবে, এক বছরে (আগস্ট ২০২৪-জুলাই ২০২৫) ৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ২৬৬ জনকে শুধু জুলাই গণ-অভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট মামলায় আসামি করা হয়েছে। দায়িত্ব পালনকালে নিহত হয়েছেন ৩ জন। চাকরি হারিয়েছেন ২৪ জন, বরখাস্ত হয়েছেন ৮টি পত্রিকার সম্পাদক ও ১১টি টিভি চ্যানেলের বার্তাপ্রধান। আমরা এক ভয়াল অন্ধকারে ঢুকে পড়েছি। সাংবাদিক, গণমাধ্যম, সাধারণ মানুষ—কেউই নিরাপদ নই। শেখ হাসিনার পতনের খুশিতে আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটা অকার্যকর, অর্থহীন সরকার জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে।’
তিনি আরো বলেন, “সাংবাদিকরা কী শিখবেন এই ঘটনার পর? তুহিনের ‘বোকামি’ দিয়ে শুরু করেছিলাম। আসলেই, আমাদের মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকদের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। পিআইবি নামে একটা প্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু সেটি চালানো হয় রাজনৈতিক আনুগত্যে ভরা এক দালালকে ডিজি বানিয়ে, যারা বছর বছর একই গত্বাঁধা প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে একদল ‘নির্বাচিত’ লোকদের। কেউ কি তুহিনের মতো সাংবাদিকদের বলেছে—যে চিত্র সে ধারণ করছিল, সেটা তাকে জীবনের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে? এই ধরনের ঘটনা কভার করতে গেলে কিভাবে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হয়, কবে ক্যামেরা নামিয়ে সরে যেতে হয়, কখন ‘লাইভ’ নয় বরং ‘সারভাইভ’ করতে হয়— সব শেখানো হয় না বলেই তুহিনরা মরে যায়। সাংবাদিকতার মূলনীতি পরিষ্কার : ‘সংবাদ গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু কোনো সংবাদ জীবন থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।”