মোটামুটি আট মাসের ভেতরই বউ আর ছেলের পর উকিল মুন্সীও মারা যান। উকিল মুন্সীর জীবনকাল নিয়ে আগে থেকেই আমরা বিভ্রান্ত ছিলাম। হুমায়ুন আহমেদের মধ্যাহ্ন উপন্যাসের কাহিনী ধরে ভেবে ছিলাম উকিল মুন্সী মুক্তিযুদ্ধের আগে বা ব্রিটিশ শাসনামলে মারা গেছেন। অথচ উকিলের ছেলের বউয়ের মতে সেই মৃত্যু ঘটেছে ১৯৮০ – ৮১ সালে। সেই প্রসঙ্গে বলে রাখি বারী সিদ্দীকীর বরাতে জানা যায় মৃত বউয়ের শিয়রে বসে উকিল মুন্সী বিখ্যাত শুয়াচান পাখি গানটি রচনা করেন। উকিলের গানের সাথে সাথে শিষ্য রশিদ উদ্দিন এই সুরে উকিলকে সান্ত্বনা দেন। বারী সিদ্দীকী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই গানের দুটো অংশই গেয়ে থাকেন। আবার কিছু বইয়ে লেখা আছে এই গানটি রশিদ উদ্দিনের।
কিন্তু রহিমা খাতুন এই গানের রোমান্টিক তত্ত্বটি নাকচ করে দিয়ে আধ্যাত্মিকতার দিকে গেলেন। তিনি বললেন, এইসব বানানো কথা। উকিল মুন্সী এই গান বেঁধেছিলেন তার পীর মুর্শীদকে। পীরের ব্যাপারে দাউদ আগে থেকে নিশ্চিত ছিলেন। আমার অবস্থা হলো- কিছুটা নড়েচড়ে বসলাম।
পীর যখন মারা যান, উকিল মুন্সী তার শিয়রে বসা। পীর নিজ কন্ঠে উকিলের- আতর গোলাপ ছিটাইয়া শুইয়া রইলাম বিছানায়, বন্ধু তোমারি আশায়… গানটি গাওয়ার পর সবাইকে বিদায় জানিয়ে নিজেকে চাদর দিয়ে ঢেকে দেন। চাদর ঢাকা অবস্থায় তিনি মারা যান। এই ঘটনা উকিলের মনে বড় প্রভাব ফেলে। সেই উপলক্ষ্যে উকিল গানটি রচনা করেন। উকিল রহিমাকে এই ঘটনা জানিয়েছেন। এভাবে গানের মানে যখন পরিবর্তন হয়ে যায়- তখন অন্য গানগুলো নিয়েও কথা চলে আসে। তার মধ্যে একটা হলো আষাঢ় মাইসা ভাসা পানিরে। তার আগে রহিমার খাতুনের মুখে উকিলের পীরের বৃত্তান্ত জানা যাক।
রহিমা খাতুন জানান, উকিলের পীর ছিলেন হবিগঞ্জের রিচি’র মোজাফফর মিয়া। যিনি সাহেব বাড়ীর মোজাফফর আহমেদ (রঃ) নামে পরিচিত। এই দরবার শরীফ হবিগঞ্জ শহরের কাছাকাছি, জাহাগীর দরবার শরীফ নামে পরিচিত। নেত্রকোনা থেকে হবিগঞ্জের দুরত্ব কম নয়। কিশোরগঞ্জ অথবা সুনামগঞ্জ জেলা পার হয়ে নেত্রকোনা থেকে হবিগঞ্জ যেতে হয়। বর্ষাকালে উকিল মুন্সী হয়তো নৌকা নিয়ে হাওর পার হয়ে আসতেন। কিন্তু শুকানো মওসুমে সেই পীরদর্শন কেমন ছিলো?
এই দরবারে প্রতি বছর মার্চ মাসে বার্ষিক ওরছ হয়। মোজাফফর আহমেদ হযরত শাহজালাল (রঃ) এর তিনশ ষাট জন শিষ্যের একজন সৈয়দ নাসির উদ্দিনের সিলসিলার উত্তরসূরী। মোজাফফর আহমেদের ছেলে কুতুব শাহও একজন পীর। তাদের তরিকা হলো চিশতিয়া। রহিমা খাতুনের দাদা পীরের আস্তানা চট্টগ্রামের মিজরাইল শরীফ। কক্সবাজারের কাছাকাছি। মিজরাইল শরীফ সম্পর্কিত কোন তথ্য আমরা প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাই নাই। তবে কক্সবাজারের কাছাকাছি সাতকানিয়ায় আছে মির্জারখিল দরবার। তবে রহিমা খাতুন মিজরাইল শরীফ বলতে এই দরবারকে বুঝিয়েছেন কিনা সে বিষয়ে আরো অনুসন্ধানের পর আমরা নিশ্চিত হতে পারব। উকিল মুন্সী মোজাফফর আহমেদের পাঁচ খলিফার একজন। উকিলেরও কয়েকজন মুরিদ ছিলো। এখন রহিমা খাতুনের চাচী শাশুড়ী ছাড়া উকিলের কোন মুরিদ জীবিত নাই। পীরের ছেলের কুতুব শাহের কাছে তিনি আর তার স্বামী মুরিদ হন। এই বিষয়ে পরবর্তী অনুসন্ধানের ইচ্ছা আছে। তিনি আরো জানান- পীরের নাতি বলেছেন, উকিল মুন্সীকে আমার দাদা খেলাফত দিয়েছেন। তাকে শুধু উকিল মুন্সী বলবেন না- বলবেন হযরত উকিল মুন্সী।