Your Ads Here 100x100 |
---|
বিশ্বে ইসলামি ব্যাংকিং ধারণার বাস্তব প্রয়োগ প্রথম শুরু হয়েছিল মিসরে। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে দেশটিতে কয়েকটি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব ব্যাংকের অর্থায়নে বিশেষ পুঁজিপতি শ্রেণির বিকাশ ঘটে, যা মিসরের শিল্প খাতের ভিত মজবুত করে।
ষাটের দশকের পর সত্তর ও আশির দশকে ইসলামি ব্যাংকিং সারা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। শরিয়াহভিত্তিক এ ব্যাংকিং ব্যবস্থার মূলনীতি ছিল—‘সম্পদ যেন কেবল মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়।’ এই মূলনীতি অনুসরণ করে ইসলামি ব্যাংকগুলো বিনিয়োগকে প্রান্তিক পর্যায়েও ছড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশেও ১৯৮৩ সালে ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়, যার মূলনীতিও ছিল একই। এর ফলে কয়েক লাখ নতুন উদ্যোক্তার সৃষ্টি হয়। অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পরে দেশের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীতে পরিণত হন। তবে দেশের সর্ববৃহৎ এই ব্যাংকটি সেই সাফল্যের ধারা ধরে রাখতে পারেনি।
বর্তমানে কেবল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি নয়, বরং প্রায় সব শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকই সংকটের সম্মুখীন। সুশাসনের অভাব, বেনামি ঋণ ও দুর্নীতির কারণে অন্তত সাতটি ব্যাংক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পেরে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ঋণ বিতরণ কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।
ইসলামি ব্যাংকের একজন বিনিয়োগ গ্রহীতা, রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সিরাজুস সালেকিন চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের কৃষি ও প্রাণিসম্পদ খাতে বিনিয়োগের প্রধান উৎস ছিল ইসলামী ব্যাংক। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে চলতি মূলধন না পাওয়ায় আমাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া ইউরোপ-আমেরিকাসহ সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশগুলো এখন আর ইসলামী ব্যাংকের এলসি গ্রহণ করছে না, যা আমাদের ব্যবসার জন্য বড় সংকট সৃষ্টি করেছে।’
বিশ্লেষকদের মতে, ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর সংকট দেশীয় পুঁজি বিকাশে বড় বাধা সৃষ্টি করেছে। অতীতে এসব ব্যাংকের অর্থায়নে যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, তারা এখন চলতি মূলধন পাচ্ছে না। ফলে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, কর্মসংস্থানের পথও সংকুচিত হয়েছে।
বাংলাদেশে কার্যরত অন্যান্য শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে—আল-আরাফাহ্ ইসলামি ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। এর মধ্যে ছয়টি ব্যাংক একসময়ে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক শরিয়াহভিত্তিক সাতটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ইসলামী ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা, যা দেশের মোট ব্যাংক আমানতের ২৫ শতাংশ। একই সময়ে ইসলামী ব্যাংকিং খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৭০ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা, যা মোট ব্যাংক ঋণের ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ, আমানতের তুলনায় ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি।
ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, ‘১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক সঠিকভাবে পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু এরপর থেকে অনিয়ম শুরু হয়, যার ফলে বর্তমান সংকট সৃষ্টি হয়েছে।’
ইসলামি ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটের কারণে পুরো ব্যাংক খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ৯.৮ শতাংশ, কিন্তু ডিসেম্বর শেষে তা মাত্র ৭.২৮ শতাংশে নেমে এসেছে।
বিশ্বব্যাপী ইসলামি ব্যাংকিং এখনও দ্রুত বিকাশমান। প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের তুলনায় শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের প্রবৃদ্ধি প্রায় দ্বিগুণ। ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে বার্ষিক ১৭ শতাংশ হারে শরিয়াহভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থার প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ২০২২ সালে বৈশ্বিক ইসলামিক ফাইন্যান্সের সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪.৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা ২০২৭ সালে ৬.৭ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইসলামী ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে এটি আবারও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে।