Your Ads Here 100x100 |
---|
সাব্বির হোসেন, লালমনিরহাট প্রতিনিধি
২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) এর গুলি ও নির্যাতনে ৩০৫ জন বাংলাদেশি নিহত এবং ২৮২ জন আহত হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে, যা সীমান্তে নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের নাজুক চিত্র ফুটে তুলেছে ।
এইচআরএসএসের তথ্যানুযায়ী, গত দশকে সর্বোচ্চ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ২০২০ সালে (৫১ জন নিহত), এরপর ২০১৫ (৪৩ জন) এবং ২০১৯ সালে (৪২ জন)। নিচের টেবিলে বছরে হতাহতের বিস্তারিত চিত্র:
| বছর | নিহত | আহত |
|——–|——-|——-|
| ২০১৫ | ৪৩ | ৫৪ |
| ২০১৬ | ২৮ | ২৮ |
| ২০১৭ | ৩০ | ৩৭ |
| ২০১৮ | ১৫ | ১২ |
| ২০১৯ | ৪২ | ২৫ |
| ২০২০ | ৫১ | ২৫ |
| ২০২১ | ১৭ | ১৪ |
| ২০২২ | ২৩ | ৩১ |
| ২০২৩ | ৩০ | ৩১ |
| ২০২৪ | ২৬ | ২৫ |
২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসেই ইতিমধ্যে ৪ জন নিহত এবং ১০ জন আহত হওয়ার খবর নথিভুক্ত হয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের পিছনে কারণ
১. শ্যুট-অন-সাইট নীতি: বিএসএফের বিতর্কিত “দেখামাত্র গুলি” নীতি প্রধান কারণ। এই নীতির অজুহাতে নিরস্ত্র কৃষক, গবাদি পশু ব্যবসায়ী এবং সাধারণ নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়।
২. চোরাচালান ও অর্থনৈতিক সংকট: ৯০% হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিরা গরু পাচার বা দারিদ্র্যের কারণে সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
৩. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সীমান্ত পারাপারের চেষ্টা বেড়ে যাওয়ায় বিএসএফের কঠোরতা বৃদ্ধি পায়।
৪. জবাবদিহিতার অভাব: বিএসএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি, যা তাদের স্বেচ্ছাচারিতাকে উৎসাহিত করে।
ভৌগোলিক বৈষম্য ও ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল
রংপুর ও রাজশাহী বিভাগ: সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এখানে। ২০২০-২০২৪ সালে রংপুরে ৬১ জন নিহত হন।
লালমনিরহাট জেলা: গত পাঁচ বছরে ১৯ জন নিহত হওয়ায় এটি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জেলা।
অরক্ষিত সীমান্ত: যেসব এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নেই (যেমন যশোরের বেনাপোল), সেখানে হামলার ঘটনা বেশি।
দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও ব্যর্থতা
২০১৮ সালের চুক্তিতে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। পতাকা বৈঠক ও কূটনৈতিক আলোচনা সত্ত্বেও বিএসএফের গুলিবর্ষণ অব্যাহত রয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) মতে, ২০০৯-২০২৪ সালে ৬০৭ জন বাংলাদেশি বিএসএফের হাতে প্রাণ হারান।
মানবাধিকার সংস্থার প্রতিক্রিয়া ও সুপারিশ এইচআরএসএস: সব হত্যাকাণ্ডের স্বাধীন তদন্ত ও আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়েরের আহ্বান।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ: বিএসএফের “অত্যধিক বলপ্রয়োগ” নীতির নিন্দা এবং ভারতের আইনের শাসন নিশ্চিত করার দাবি।
বিশেষজ্ঞ মতামত: সীমান্তে অহিংস পদ্ধতি (যেমন রাবার বুলেট) প্রয়োগ এবং স্থানীয় জনগণের সাথে সমন্বয় বাড়ানোর পরামর্শ।
সম্ভাব্য সমাধানের পথ
১. শ্যুট-অন-সাইট নীতি বাতিল: নিরস্ত্র নাগরিকদের লক্ষ্য করে গুলি বন্ধ করতে হবে।
২. দ্বিপক্ষীয় তদন্ত কমিটি গঠন: প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করা।
৩. সীমান্ত অবকাঠামো উন্নয়ন: কাঁটাতারের বেড়া ও সিসি ক্যামেরা স্থাপনের মাধ্যমে নজরদারি বৃদ্ধি।
৪. আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা: জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশনের হস্তক্ষেপ কাম্য।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যাকাণ্ড কেবল সংখ্যায় নয়, মানবিক ও কূটনৈতিক সংকট হিসেবেও উদ্বেগজনক। দুই দেশের সরকারের জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে এই রক্তপাত বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। প্রতিটি প্রাণহানির পেছনে যে মানবিক ট্র্যাজেডি লুকিয়ে আছে, তা বিবেচনায় এনে ন্যায়বিচার ও স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করতে হবে।