Your Ads Here 100x100 |
---|
নিউজ ডেস্ক
বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বড় ধরনের তারল্য সংকটে পড়েছে দেশের ব্যাংক খাত। এর ফলে ঋণ জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এমন বাস্তবতায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি পূরণে চাপের মুখে পড়েছে সরকার। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে সংশোধিত বাজেট অনুমোদন করেছে অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের বৈঠকে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কমানো হয়েছে এবং বৈদেশিক ঋণ ১৪ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। ফলে ব্যাংক ঋণের পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার কোটি টাকায়। অন্যদিকে, বৈদেশিক ঋণ ৯৫ হাজার কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।
এ ছাড়া, একই বৈঠকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৬.৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে এবং মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৬.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজেটের আকারও ৫৩ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৭ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার এসে আগের সরকারের কিছু অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাতিল করেছে, যার ফলে বিপুল অর্থ সাশ্রয় হয়েছে। তিনি আরও উদাহরণ দেন মেট্রোরেলের সংস্কার ব্যয়ের ক্ষেত্রে—যেখানে আগের সরকার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব দিলেও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সেটি ১০ কোটি টাকায় সম্পন্ন করেন। এসব উদ্যোগ বাজেট ব্যয় কমাতে সহায়ক হয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এক কর্মকর্তা জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার ফলে দাতা সংস্থাগুলো আগের তুলনায় বেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এ কারণে বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ব্যাংক ঋণ ৯৯ হাজার কোটি টাকা হলেও, জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত সরকার ইতিমধ্যে ৯৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে ৪১ হাজার কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধে ব্যয় হওয়ায় নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে, যখন প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয় সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি এবং সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলার কারণে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে জানান, গত এক বছরে ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি দেড় লাখ কোটি টাকা হয়নি। অথচ সরকার ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিতে চেয়েছিল। এতে বেসরকারি খাতের জন্য ঋণ সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। পাশাপাশি, সরকারের পণ্য আমদানি প্রকল্পগুলোতে ডলার বাজার থেকে সংগ্রহ করায় বৈদেশিক মুদ্রা বাজারেও চাপ তৈরি হয়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর রাজনৈতিক বাস্তবতায় পরিবর্তন আসে, যার ফলে বাজেট বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। একই সময়ে অর্থনীতিতে সংকট ঘনীভূত হয়—বন্দর কার্যক্রমে স্থবিরতা, আমদানি-রপ্তানিতে ধীরগতি, মাঠ পর্যায়ে উন্নয়ন কার্যক্রমে স্থবিরতা এবং রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দেয়।
অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে এনবিআরের তথ্য উপস্থাপন করা হয়, যেখানে দেখা যায় চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আদায় হয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা, যা আগের দুই অর্থবছরের তুলনায় কম। একই সময়ে কাস্টমস ডিউটি আদায় হয়েছে ২৯ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা এবং আয়কর আদায় হয়েছে মাত্র ৭৩ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা—যা আগের দুই অর্থবছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।
এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, ঘোষিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যেখানে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, সেখানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণে অতিরিক্ত রাজস্ব আহরণের চাপ আরও বাড়িয়েছে। এ কারণে সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। অন্যান্য আয়ও কমিয়ে ধরা হয়েছে।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, চলমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রবৃদ্ধি অর্জনে বেশি মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে না। তাই অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ১.৭৫ শতাংশ কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে এবং মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টদের মতে, মূল্যস্ফীতি বর্তমান পরিস্থিতিতে ৮ শতাংশের নিচে রাখা কঠিন হবে।