28 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, মে ১, ২০২৫

সীমান্তে বিদায়: আতারি-ওয়াঘা সীমান্তে হৃদয়বিদারক বিচ্ছেদ

জনপ্রিয়
- Advertisement -
Your Ads Here
100x100
নুর রাজু, স্টাফ রিপোর্টার :

আতারি-ওয়াঘা সীমান্ত, ভারত — বিদায় বলার মুহূর্ত এসে গেছে। প্রচণ্ড রোদে দাঁড়িয়ে সায়রা, কালো নেটের বোরখায় আবৃত, স্বামীর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন — আরও কিছু মুহূর্ত একসঙ্গে কাটানোর আশায়। পাশে ছিল তাঁদের নয় মাসের ছেলে আজলান। স্থানটি ছিল ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের প্রধান চেকপোস্ট।

ভারতের আতারি ও পাকিস্তানের ওয়াঘা গ্রামের নামে নামকরণ করা এই সীমান্ত বহু বছর ধরে দুই দেশের মানুষের যাতায়াতের একমাত্র প্রবেশপথগুলোর একটি। কিন্তু সম্প্রতি ঘটে যাওয়া প্রাণঘাতী হামলার জেরে আতারি-ওয়াঘা সীমান্ত এখন পরিণত হয়েছে বিভাজনের প্রতীক হিসেবে—যেখানে পরিবারগুলো দ্বিখণ্ডিত হচ্ছে, কেউ ভারতীয়, কেউ পাকিস্তানি।

সায়রা ও ফারহান একসঙ্গে রাতভর সফর করে দিল্লি থেকে এখানে পৌঁছান, তাঁদের কোলে তখন ঘুমন্ত শিশু আজলান। ভারতের কাশ্মীরের পাহেলগামে ভয়াবহ হামলার পর পাকিস্তানি নাগরিকদের দেশ ত্যাগের নির্দেশ দেয় ভারত সরকার। নয়াদিল্লির ফারহানের সঙ্গে তিন বছর আগে ফেসবুকে পরিচয় হয় করাচির সায়রার। প্রেম, তারপর বিয়ে — এবং সায়রার ভারতে আসা।

সীমান্ত চেকপোস্টে, কাঁটাতারের গণ্ডি আর ব্যারিকেডের মধ্যে তাঁদের পরিচয়ের একমাত্র চিহ্ন ছিল পাসপোর্টের রঙ—সায়রার সবুজ, ফারহানের নীল।

“আল্লাহ চাইলে খুব শিগগিরই দেখা হবে,” ফারহান বললেন, আজলানের গালে চুমু খেয়ে। কিন্তু সেই আশার বেলুন দ্রুতই চুপসে গেল। এক সীমান্তরক্ষী আজলানের পাসপোর্ট দেখে জানালেন—সে ভারতীয় নাগরিক।

“বাচ্চাকে নিতে পারবেন না, ম্যাডাম,” জানিয়ে দিলেন তিনি।

এক মুহূর্তের ভেতর পরিবারটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। আজলান রয়ে গেল বাবার সঙ্গে দিল্লিতে, আর সায়রা ফিরলেন একা করাচিতে—স্তনদুগ্ধপানরত শিশুকে ছেড়ে।

এমন করুণ বিদায়ের ঘটনা এখানেই থেমে নেই। ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পাহেলগামে এক বন্দুকধারীর হামলায় ২৬ জন নিহত হন—প্রধানত পর্যটক। ভারত এর জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করলেও, ইসলামাবাদ অভিযোগ অস্বীকার করে নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানায়।

একে অপরের ওপর গোলাবর্ষণ করছে দু’দেশ, ছয়দিন টানা। বন্ধ হয়েছে ইন্দাস নদীর পানি বণ্টন চুক্তি। ভেঙে পড়েছে কূটনৈতিক সম্পর্ক, প্রত্যাহার করা হয়েছে নাগরিকদের। আতারি-ওয়াঘা সীমান্তও বন্ধ—সব ধরনের যাতায়াত ও বাণিজ্যের জন্য।

২২ এপ্রিল থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৭৫০ পাকিস্তানি সীমান্ত পেরিয়ে ফিরে গেছেন, ফিরেছেন প্রায় ১,০০০ ভারতীয়। তাঁদের মধ্যে কেউ এসেছিলেন মা-বাবার বাড়ি, কেউ বোনের বিয়েতে, কেউ আবার প্রাণঘাতী রোগের চিকিৎসায়।

৪৮ বছর বয়সী হালিমা বেগমের গল্প আরও বিষণ্ন। ২৫ বছর আগে ওডিশার এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিয়ে করে ভারতে চলে আসা হালিমা দুই সন্তানসহ ফিরে যাচ্ছেন করাচিতে—একটা ঠিকানা ছাড়াই।

“আমি তো আর অতিথি নই, আমার জীবন এখানে তৈরি হয়েছে,” বললেন তিনি চোখ মুছতে মুছতে। “কিন্তু এখন আমি কোথায় যাবো? আমার বাবা-মা নেই, ভাইয়ের ঘর ঠাসা ছয়জন সদস্যে।”

তাঁর দুই ছেলের একজন, জুবায়ের, চেষ্টা করেছিলেন মায়ের সঙ্গে ফিরে যাওয়ার। কিন্তু দুই ছেলেরই পাসপোর্ট ভারতীয় হওয়ায় অনুমতি মেলেনি। “মা কখনও একা ভ্রমণ করেননি। ও কীভাবে সামলাবে জানি না,” বললেন বড় ছেলে মোসাইব।

এই সমস্ত হৃদয়বিদারক ঘটনার পেছনে যে রাজনৈতিক বাস্তবতা, তা অনেক পুরনো। লেখক সুচিত্রা বিজয়ন বললেন, উপমহাদেশে এ রকম অগণিত পরিবার বিভক্ত হয়েছে—প্রেম, বিয়ে কিংবা জন্মভূমির কারণে। বিশেষত মুসলিম নারীরা সবচেয়ে বেশি ভুগেছেন সীমান্ত দ্বন্দ্বে।

“এই পরিবারগুলো সব সময় ভেবেছে, সাময়িক বিচ্ছেদ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন,” বলেন সুচিত্রা।

আবার ফিরে আসা যাক ফারহান ও সায়রার গল্পে। আজলান ক্ষুধায় কাঁদছিল, দুধের বোতলকে খেলনার মতো উড়িয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন ফারহান। পাশে ছিলেন ফারহানের বোন নূরীন এবং মা আয়েশা বেগম।

“দুটি শক্তিশালী দেশের বিবাদে এক শিশুর জীবন দগ্ধ হচ্ছে,” বললেন নূরীন। “একজন মায়ের কষ্ট কেউ বুঝবে না, যে তার নবজাতককে ছেড়ে যাচ্ছে।”

হঠাৎই গার্ডদের একজন ফারহানের নাম ধরে ডাক দেন। মনে হয়, অবশেষে সায়রার সঙ্গে আজলানকেও যেতে দেওয়া হবে। কিন্তু এক ঘণ্টা পর ফিরে এলেন ফারহান—হতাশ চোখে, বাচ্চাকে বুকে চেপে ধরে।

“সীমান্ত পার হওয়ার সময় সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞান ফেরার পর কাঁদতেই থেকেছে,” বললেন তিনি।

শেষবারের মতো একটি সাক্ষাৎ দেন কর্তৃপক্ষ—সায়রার সঙ্গে ছেলেকে মেলাতে।

“আমাদের জীবনটা আগে একরকম ছিল,” বললেন ফারহান। “ও আসার পর বদলে গিয়েছিল। এখন আবার সবকিছু বদলে গেছে — এমনভাবে, যা কখনও কল্পনাও করিনি।”

আয়েশা বেগম, যিনি পায়ে চোট নিয়েও ছেলের সঙ্গে ছিলেন, শেষমেশ বললেন এক বাক্যে—

“পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় প্রেম কোরো, কিন্তু পাকিস্তানে নয়।”

- Advertisement -spot_img
সর্বশেষ

সব ধরনের জালানির দাম কমলো ১ টাকা

নিউজ ডেস্ক আগামীকাল থেকে সব ধরনের জ্বালানি তেল — ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন এবং পেট্রোল — এর দাম গত মাসের চেয়ে...