- Advertisement -
| Your Ads Here 100x100 |
|---|
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক অস্বাভাবিক ও জটিল বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক গণ অভ্যূত্থানের মুখে পতনের শিকার হয়! রাষ্ট্রীয় চাপ, নেতৃত্বের পলায়ন এবং মামলা–হামলার বহুমুখী চাপে কার্যত টিকে থাকার লড়াই করছে। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের অনেকে বিদেশে অবস্থান করছেন, তৃণমূলের বহু নেতা কর্মী মামলা ও দমন–পীড়নের ভয়ে কার্যত রাজনৈতিক অচলাবস্থায়। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আধিপত্য বিস্তার করা এই দলটির এমন বিপর্যয় শুধু ক্ষমতার পালাবদল নয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির
জন্য একটি বড় মোড় নির্দেশ করছে। এই শূন্যতার সুযোগে বিএনপি এবং জামায়াত—দুই ভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি—নতুন করে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে নামছে, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমীকরণকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে।
বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য অবদান রাখা এবং মধ্যপন্থী, উদারনৈতিক চরিত্রে প্রতিষ্ঠিত বিএনপি এখনও বিস্ময়করভাবে শক্তিশালী তৃণমূল ভিত্তি ধরে রেখেছে। যা তাদের পুনরুত্থানের প্রধান শক্তি। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিএনপির পারিবারিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক শিকড় এত গভীর যে দমন–পীড়ন, কারাবরণ বা আন্দোলনের ব্যর্থতা সত্ত্বেও দলটি মাটির সঙ্গে সংযোগ হারায়নি। এই বাস্তবতা আওয়ামী লীগের ক্রমাগত পশ্চাদপসরণের মধ্যে বিএনপিকে একটি স্বাভাবিক সুবিধা দিচ্ছে। তবে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের দীর্ঘ অনুপস্থিতি, কৌশলগত দ্বিধা এবং মাঝে মাঝে সংঘাতমুখী রাজনীতি তাদের আধুনিক ও সমঝোতামূলক ভাবমূর্তিকে ক্ষীণ করে দিচ্ছে। একদিকে দমন–পীড়নের ক্ষোভ দলটিকে আক্রমণাত্মক করে তুলছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং দেশের মধ্যপন্থী ভোটাররা বিএনপির কাছে একটি গণতান্ত্রিক ও সমঝোতামূলক বার্তা প্রত্যাশা করছে। এই দুই চাহিদার দ্বন্দ্ব দলটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। যদি বিএনপি অতিরিক্ত প্রতিশোধমূলক রাজনীতিতে ডুবে যায়, তবে তরুণ প্রজন্মের উদারনৈতিক ভোটার এবং আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা নষ্ট হতে পারে, যা নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
অন্যদিকে জামায়াত ইসলামী বহুদিন ধরেই সংঘাত এড়িয়ে মানবিক সেবা, শিক্ষা, দাতব্য কার্যক্রম ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমাজে প্রভাব বিস্তারের কৌশল নিয়েছে। সরাসরি ক্ষমতা দখলের চেয়ে তারা ধীর, কিন্তু স্থায়ী সামাজিক প্রভাব তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি, ছাত্ররাজনীতি এবং ধর্মীয় নেটওয়ার্কে তাদের উপস্থিতি এই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনারই ফল। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাদের ছাত্র সংগঠনের সাফল্য এই কৌশলের কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্বের সুযোগে জামায়াত অনেকটাই নীরবে সেই শূন্যতায় নিজেদের প্রভাব বিস্তার করছে। আওয়ামী লীগের পতনে হতাশ সাধারণ ও ধর্মপ্রাণ ভোটারদের একটি অংশ, যারা বিএনপির সংঘাতমুখী রাজনীতিতে অনাগ্রহী, তারা ক্রমশ জামায়াতের সেবামূলক ও সংগঠিত চেহারার দিকে ঝুঁকছে।

এই প্রেক্ষাপটে ২০২৬ সালের নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতি এক ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রবেশ করেছে। আওয়ামী লীগ মূলত আত্মরক্ষার লড়াইয়ে ব্যস্ত, বিএনপি সুযোগের প্রধান দাবিদার হলেও সংঘাতমুখী কৌশলের কারণে মধ্যপন্থী ভোটার হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে, আর জামায়াত ধীরে ধীরে জনমনে সামাজিক আস্থা তৈরি করে এগিয়ে চলেছে। ভোটের বড় একটি অংশ আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সমর্থকদের নিয়ে গঠিত, যারা এখন রাজনৈতিকভাবে ভাসমান। এই ভোটাররা একদিকে বিএনপির দিকে ঝুঁকলেও, জামায়াতের নীরব ও সেবামূলক কৌশল তাদের জন্য নতুন আকর্ষণ তৈরি করছে। ফলে আওয়ামী লীগের শূন্যতা বিএনপি পুরোপুরি দখল করতে পারবে—এমন নিশ্চয়তা নেই।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচন তাই শুধু একটি ক্ষমতার পালাবদল নয়, বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশক। বিএনপি যদি নিজেদের মধ্যপন্থী, উদারনৈতিক চরিত্র আরও স্পষ্ট করে তৃণমূলের শক্তিকে সংগঠিত রাখতে পারে এবং সংঘাতমুখী রাজনীতি থেকেঅভ্যুত্থানের আধুনিক, জনমুখী বার্তা উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়, তবে তারা আওয়ামী লীগের পতনের ফলে তৈরি হওয়া শূন্যতার বড় অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে। কিন্তু যদি তারা প্রতিশোধের রাজনীতিতে বেশি ডুবে যায় বা কৌশলগত ঐক্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়, তবে জামায়াতের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা—যেখানে সামাজিক প্রভাব ও মেধাভিত্তিক সংগঠন প্রধান—বিএনপির চেয়ে বেশি কার্যকর প্রমাণিত হতে পারে।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এক ধরনের ত্রিমাত্রিক ভারসাম্য তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগ এখন অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে ব্যস্ত এক প্রাক্তন শাসকগোষ্ঠী; বিএনপি শক্তিশালী তৃণমূল ও গণতান্ত্রিক ইতিহাসের ওপর দাঁড়িয়ে সম্ভাব্য প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও সংঘাতমুখী কৌশলের ঝুঁকিতে; আর জামায়াত সুসংগঠিত, নীরব এবং বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে ধীরে ধীরে জনমনে জায়গা করে নিচ্ছে। ২০২৬ সালের নির্বাচন প্রমাণ করবে, এই তিন শক্তির মধ্যে কে নতুন বাংলাদেশের রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে। বিএনপির সামনে সুযোগ বড়, কিন্তু সঠিক কৌশল ছাড়া সেই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলে জামায়াতের ধৈর্যশীল সামাজিক প্রভাবই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় চমক হয়ে উঠতে পারে।
-মাহমুদ দিদার
লেখক,চলচ্চিত্রকার,এক্টিভিস্ট।


