Your Ads Here 100x100 |
---|
নীরব ভোরে ঘাসের ফোঁটার ওপর ঝুলে থাকা মাকড়সার জাল যেন প্রকৃতির আঁকা এক অপূর্ব জলছবি। সূর্যের কোমল আলো যখন জালের প্রতিটি তন্তুকে ছুঁয়ে যায়, তখন মনে হয় যেন হাজারো ছোট্ট রত্ন জ্বলজ্বল করছে। এই সূক্ষ্ম অথচ জটিল স্থাপত্য শুধু প্রকৃতির শৈল্পিক ক্ষমতার নিদর্শন নয়, বরং জীবনের এক গভীর দর্শনও বটে।
সূক্ষ্মতা ও স্থিতির নিখুঁত সঙ্গমে তৈরী মাকড়সার প্রাসাদ যতটাই নাজুক, ততটাই দৃঢ়। তন্তুগুলো এমনভাবে জোড়া লাগে যে বাতাসের দোলায় নড়ে তবু ছিঁড়ে যায় না। প্রাকৃতিক এই স্থাপত্যে যেন স্থিতি আর গতির এক আশ্চর্য সমন্বয়ে জীবনকে বুঝিয়েছে, সবকিছু ক্ষণস্থায়ী হলেও ভেতরে লুকিয়ে থাকে অনন্ত শক্তির প্রবাহ।
প্রাকৃতিক এই রাজমিস্ত্রী মাকড়সারা নিজস্ব শিল্পে নিপুণ শিল্পী। নিজেদের গ্রন্থি হতে নিঃসৃত প্রোটিন দিয়ে এমন এক জাল বুনে ফেলে যা লোহার থেকেও শক্তিশালী এবং তুলার থেকেও নমনীয়। এই দক্ষতায় মুগ্ধ এবং নত হয়ে বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতে এই জাল থেকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি — যেমন বুলেটপ্রুফ কটন বা উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরী করার দিকে লক্ষ্য রাখছেন।
শুধু বিজ্ঞানে নয় ইতিহাসের পাতায়ও মাকড়সা ততটাই ঐতিহাসিক। স্কটল্যান্ডের কিং রবার্ট দ্য ব্রুস বারবার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হতাশায় ডুবে একটি গুহায় আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি দেখেন একটি মাকড়সা বারবার চেষ্টা করেও জাল বুনতে ব্যর্থ হয়েও হাল ছাড়েনি এবং অবশেষে সফল হয় মাকড়সাটি। সেই অধ্যবসায় থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্রুস পুনরায় যুদ্ধ করেন এবং বিজয় অর্জন করেন।
মাকড়সা শুধু স্কটল্যান্ডের যুদ্ধের ময়দানে নয়, জায়গা করে নিয়েছে বাংলা সাহিত্য জগতেও। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে কালজয়ী চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীর একটি রহস্যময় কাহিনি “অদ্বিতীয়”-তে মাকড়সার রস ব্যবহার করে এক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। সেই বিষাক্ত রস হয়ে ওঠে গল্পের কেন্দ্রবিন্দু।
বিষাক্ত এই মাকড়সার ভয়ে তৈরী হয়েছে নানাবিধ ভৌতিক সিনেমাও। ১৯৯০ সালে মুক্তি পাওয়া মুভি “Arachnophobia” ও ২০০২ সালের “Eight Legged Freaks” সিনেমাগুলোতে দেখা যায় দৈত্যাকার মাকড়সার ভয়ঙ্কর উপস্থিতি, যা দর্শকদের শিহরিত করেছে। অন্যদিকে মার্ভেলের জনপ্রিয় সুপারহিরো মুভি সিরিজ “Spider Man” জায়গা করে নিয়েছে দর্শকের মনে।
পরিশেষে এটিকুই বলা যায় এক অনন্ত অনুপ্রেরণাদায়ক এই মাকড়সার জীবনচক্র। মা মাকড়সার বলিদান যেমন শেখায় সন্তানের প্রতি গভীর মমত্ববোধ তেমনি সন্তানও শিখিয়ে দেয় মানব জাতীকে ধৈর্য্য এবং নিখুঁত চিন্তার দর্শন।
মাকড়সার জাল প্রকৃতির নিখুঁত কবিতার মতো সূক্ষ্ম, জটিল, কিন্তু অনুপ্রেরণাদায়ক। এটা শুধু মাকড়সার বাসস্থান নয়, বরং আমাদের জীবন, স্থিতি, ও পুনর্নির্মাণের চিরন্তন দর্শনের প্রতীক।
(~আফরিনা চম্পা ফসল~)