বিনোদন ডেস্ক :
ধর্মে নয়, ‘পিকে’ আঘাত করেছে ভণ্ড ধর্মগুরুদের! কট্টরপন্থী মৌলবাদীদের। ঈশ্বর একটাই ধর্ম তৈরি করেছেন সেটা হলো ‘মানুষ ধর্ম’! কে হিন্দু? কে মুসলমান? তার চিহ্ন কোথায় দেখাও? ‘পিকে’ হচ্ছে কাজী নজরুলের মত ‘সাম্যবাদী’ একটা ক্যারেক্টার। নজরুলের মতই জাতি,ধর্ম,বর্ণ,ধনী-গরীব,উচু-নিচুঁ সকল বিভেদ ভুলে মানবতাবাদই পরম ধর্ম।
বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার জন্য ব্যাপক সমালোচিতও হয়েছে রাজকুমার হিরানি-আমির খান জুটির সর্বশেষ ছবি পিকে। তবে, কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মতো কোনো উপাদান এই ছবিতে নেই। ছবিটি কারো আঁতে যদি ঘা দিয়েই থাকে, সেটা এই ছবির তপস্বী মহারাজ চরিত্রটির মতো ভণ্ড ধর্মগুরুদেরই দিয়েছে। যারা ধর্মব্যবসা করে খান,পিকে সিনেমায় তাদেরই আঁতে আঘাত লেগেছে।
পিকে সিনেমায় আসলে ঈশ্বর সম্পর্কে কী বলা হয়েছে, অধিকাংশ মানুষের সে ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা নেই। ‘পিকে’ চরিত্রটি নাস্তিক নয়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই, এই বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য পিকে নয়। পিকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার তো করেই না, বরং আসল ঈশ্বরের বা এক সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে তুলে ধরে। আরেকটু পরিষ্কার করে বললে পিকে সত্য ঈশ্বরের স্বরূপ উদঘাটনের এক প্রয়াস মাত্র এবং একই সঙ্গে ধর্মব্যবসায়ীদের ভণ্ডামি ও মিথ্যে শিক্ষা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
পিকের ঈশ্বরতত্ত্ব বুঝতে হলে পিকের সঙ্গে তপস্বী মহারাজের লাইভ টেলিভিশন বিতর্ক দৃশ্যটি মনোযোগ গিয়ে দেখতে হবে। তপস্বীর প্রশ্নের জবাবে পিকে স্বীকার করে নেয় যে দুর্দিনে ঈশ্বরই ছিলেন তার সহায়। ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখলে মানুষ আশা পায়, ভরসা পায়। প্রতিকূল সময় মোকাবিলায় সাহস ও শক্তি পায়। তবে একই সঙ্গে পিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, কোন ঈশ্বরে বিশ্বাস করব? যে ঈশ্বর আমাদের সবাইকে বানিয়েছেন, না যে ঈশ্বরকে তপস্বীর মতো ভণ্ড গুরুরা বানিয়েছে?
পিকে বলে, যে ঈশ্বর আমাদের বানিয়েছেন, তার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। কিন্তু যে ঈশ্বরকে তোমরা বানিয়েছ, সে ঈশ্বর ঠিক তোমাদেরই মতো। তোমাদের তৈরি ঈশ্বর মিথ্যাবাদী, ছল, ভুয়া প্রতিশ্রুতি দেয়। ধনীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখায়, গরিবদের অবহেলা করে। তোষামোদে খুশি হয়। মানুষকে ভয় দেখায়।
সঠিক পথ কী, সেটা সম্পর্কে পিকের বক্তব্য হলো, যে ঈশ্বর আমাদের সবাইকে বানিয়েছেন, তার ওপর বিশ্বাস রাখো। আর তপস্বীর মতো ভণ্ড ধর্মগুরুরা যে ঈশ্বরকে বানিয়েছে, তাকে ছুড়ে ফেলো। এই পর্যায়ে তপস্বী বলেন, তুমি আমাদের ঈশ্বরের ওপর হাত তুলবে, আর আমরা চুপ করে বসে থাকব? না, বরং আমরা আমাদের ঈশ্বরকে রক্ষা করব।
তপস্বীর এই কথায় পিকে খানিকটা রেগে যায়। সে বলে, তুমি করবে ঈশ্বরকে রক্ষা? পৃথিবী ছোট্ট একটি গ্রহ। মহাবিশ্বে পৃথিবীর চেয়ে বড় লক্ষ কোটি গ্রহ ঘূর্ণয়মান। আর তুমি এই ছোট্ট গ্রহের এক ছোট্ট শহরের ক্ষুদ্র গলিতে বসে বলো তুমি তাকে রক্ষা করবে, যিনি এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। তাকে রক্ষার জন্য তোমাকে প্রয়োজন নেই। তার রক্ষা তিনি নিজেই করতে পারেন। তার পরও মানুষ যদি যার যার ঈশ্বরকে রক্ষা করতে চায়, তবে যে হানাহানি, বোমাবাজি অনিবার্য, যাতে মানবজাতির অস্তিত্ব পড়বে হুমকির মুখে। এ ক্ষেত্রে পিকে ট্রেনে বিস্ফোরিত বোমায় নিহত বন্ধু ভেরো সিংয়ের (সঞ্জয় দত্ত) প্রসঙ্গ টেনে আনে।
এই কথার উত্তরে তপস্বী বলে, এক মুসলমানের ফেলা বোমার দায় তার মতো হিন্দু গুরু কেন নিতে যাবে। পিকে তাকে বলে- কে হিন্দু, কে মুসলমান তার চিহ্ন কোথায় দেখাও। এই ভিন্নতা ঈশ্বর না, তোমরা বানিয়েছ, যা এই গ্রহের সবচেয়ে ভয়ানক ভুল। ধর্মের এই বিভক্তির ফলে মানুষ মরে, একে অন্যের কাছ থেকে আলাদা হয়। যেমনটা হয়েছিল ছবির নায়িকা হিন্দু জগগু ও মুসলমান সরফরাজের (সুশান্ত সিং রাজপুত) প্রেমের ক্ষেত্রে।
ধর্ম নিয়ে পিকের বক্তব্য খুবই সোজা। আসল ঈশ্বর ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম তৈরি করেননি, বরং মানুষ করেছে। আলাদা আলাদা ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আলাদা আলাদা ঈশ্বরও তৈরি করেছে। কিন্তু আসল ঈশ্বর একটি ধর্মই সৃষ্টি করেছেন। সেটা হলো মানবধর্ম। মানুষই ঈশ্বরের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মীয় রীতি-নীতি, আচার-আচরণ, পূজা-প্রার্থনা কিংবা ঈশ্বরের জন্য অযথা ত্যাগ-স্বীকার নয়, মানুষের জন্য, মানুষের কল্যাণে কিছু করাটাই ঈশ্বরের কাছে প্রধান বিষয়। অথচ আমরা সেটা ভুলে মানুষের মাঝে তুলে দিই ধর্মীয় বিভেদের দেয়াল। ধর্মের নামে করি মানুষ হত্যা। মানুষের কল্যাণই সৃষ্টিকর্তার লক্ষ্য ও ইচ্ছা। এতে নেই কোনো ছোট-বড়, ধনী-গরিব, মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মের ভেদ।
স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে কষ্ট দেয়ার কোনো মানে নেই। সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করার জন্য নিজের পিঠ রক্তাক্ত করার চেয়ে একজন মানুষকে বাঁচানোর জন্য দুটো কিল-ঘুষি হজম করা বহুগুণে শ্রেয়। একদল মূর্খ লোক না জেনে আত্মপীড়ন করে ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করতে চায়, আর একদল অতি চালাক ও দুষ্ট লোক নিজেদের ফায়দা ওঠানোর জন্য এই ধরনের রীতিকে উসকে দেয়।
সুতরাং সত্যিই যদি আপনি সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য পেতে চান, তবে এখনই মানুষের কল্যাণে ব্রতী হন। মানুষকে ভালোবাসুন। মানুষের মতবাদ বা কোনো কথায় উত্তেজিত হয়ে তার ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকুন। ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করুন। সেটা যদি ইতিবাচক হয় তবে গ্রহণ করুন। যদি সেটা আপনার কাছে ভালো মনে না হয়, তবে পরিহার করুন।