34 C
Dhaka
শনিবার, মার্চ ১৫, ২০২৫

ফরীদিবিহীন আরেকটি বসন্ত

জনপ্রিয়
- Advertisement -
Your Ads Here
100x100

 

ফাগুনের এক মাতাল হাওয়ার দিনে প্রকৃতি যখন নবরূপে সাজার প্রস্তুতি নিচ্ছে ঠিক তখনই বাংলাদেশের শোবিজপাড়ায় উঠে শোকের মাতম। গুণী অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। সেদিন হুমায়ুন ফরীদি দেহান্তর হলেও তিনি বেঁচে আছেন এখনো অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে। এদিকে আবারও এসেছে বসন্ত, ফাগুনের আগুন লাগা রঙে সাজবে প্রকৃতি। শুধু এমন বসন্তে সেই প্রিয় হুমায়ুন ফরীদি নেই।
‘এসডিও সাহেবকে আমি সামলাব, আমার নাম হচ্ছে কাজী মোহাম্মদ রমজান- এই সুচতুর উক্তিটি সংশপ্তক নাটকে ‘কানকাটা রমজান’ চরিত্রের কুটিল ব্যক্তি হুমায়ুন ফরিদীর। এক সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত বিখ্যাত ‘সংশপ্তক’ নাটকে ‘কানকাটা রমজান’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন তিনি। যে কিনা সেই নাটকে নষ্টা ও সমাজচ্যুত হুরমতি চরিত্রের ফেরদৌসী মজুমদারের হাতে নাজেহাল হয়ে কান বিসর্জন দিয়েছিলেন! তবে অকল্পনীয় ধুরন্ধর সেই কানকাটা রমজান কিন্তু কূটবুদ্ধি করে শেষ পর্যন্ত বাকুলিয়া গ্রামের মিয়ার ব্যাটাকে সরিয়ে নিজেই একসময় জমিদার বনে যান এবং ছেচলি শের ভয়াবহ দাঙ্গার সুযোগ নিয়ে হিন্দুদের ঘরবাড়ি দখল করে নেয়। এই নাটকটিকে তার শ্রেষ্ঠ কাজও বলা যায় না। তবুও বাংলাদেশ টেলিভিশনের সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র হিসেবে বেশির ভাগ মানুষই বোধহয় ‘কানকাটা রমজান’কেই পছন্দ করবেন। ভয়ঙ্কর কুটিল, ধুরন্ধর এবং একই সঙ্গে কিছুটা কমেডি ধাঁচের রমজান চরিত্রটি ফরীদি যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তার কোনো তুলনা হতে পারে না। ব্ল্যাক কমেডির সার্থক চিত্ররূপ বলা যেতে পারে নাটকে তার অংশটুকুকে।
এইসব দিনরাত্রির পর এক যুগেরও বেশি সময় হুমায়ুন ফরীদি একাই টিভি নাটকের জনপ্রিয়তার সিংহাসন দখল করেছিলেন। অন্যদিকে হুমায়ুন আহমেদের একচেটিয়া রাজত্বে একটি নাটকই কিছুটা ভাগ বসাতে পেরেছিল। আর সেটা হলো শহীদুল্লাহ কায়সারের বহুল আলোচিত নাটক ‘সংশপ্তক’। যেখানে ফরীদি অভিনয় করেছিলেন বিখ্যাত সেই ‘কানকাটা রমজান’ চরিত্রে।
তবে সংশপ্তক নাটক প্রচারের অনেক আগে থেকেই হুমায়ুন ফরীদি মঞ্চ এবং টিভি নাটকের শীর্ষস্থানীয় অভিনেতা ছিলেন। ফরীদির সামনে নিষ্প্রভ মনে হতো সবাইকে।

টিভি নাটকের শীর্ষস্থানীয় অভিনেতা

ছন্নছাড়া স্বভাবের জন্য ফরীদিকে ‘পাগলা’, ‘সম্রাট’, ‘গৌতম’ নানা নামে ডাকা হতো। অভিনয়ে অদ্বিতীয় এই ব্যাক্তিত্ব জন্মগ্রহণ ঢাকার নারিন্দায়। তাঁর বাবার নাম এটি এম নুরুল ইসলাম ও মা বেগম ফরিদা ইসলাম। চার ভাই- বোনের মধ্যে তাঁর অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। ইউনাইটেড ইসলামিয়া গবর্নমেন্ট হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন তিনি। মাধ্যমিক সত্মর উত্তীর্ণের পর চাঁদপুর সরকারী কলেজে পড়াশোনা করেন। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনার পর স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি আল-বেরুনী হলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি বিশিষ্ট নাট্যকার সেলিম আল-দীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। সেলিম আল দীনের ‘সংবাদ কার্টুন’-এ একটি ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করে ফরিদী মঞ্চে উঠে আসেন। অবশ্য এর আগে ১৯৬৪ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে কিশোরগঞ্জে মহল্লার নাটক ‘এক কন্যার জনক’-এ অভিনয় করেন। ১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত নাট্য উৎসবে তিনি অন্যতম সংগঠক ছিলেন। মুলত এ উৎসবের মাধ্যমেই তিনি নাট্যাঙ্গনে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থাতেই তিনি ঢাকা থিয়েটারের সদস্যপদ লাভ করেন। মঞ্চে তার সু-অভিনীত নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘শকুন্তলা, ‘ফনিমনসা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’, ‘কেরামত মঙ্গল’ প্রভৃতি। ঢাকা থিয়েটার এ থাকাকালীন সময়ে তিনি ব্রেকটের ‘ধুর্ত উই’ মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৯০ সালে স্ব-নির্দেশিত ‘ভূত’ দিয়ে শেষ হয় ফরীদির ঢাকা থিয়েটারের জীবন। এরপর তিনি অনেক নাটকে অভিনয় করেন।
নব্বইয়ের গোড়া থেকেই হুমায়ুন ফরীদির বড় পর্দার লাইফ শুরু হয়। সেখানেও তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বলা হয়ে থাকে যে, শুটিংস্থলে অভিনেতার তুলনায় দর্শকরা হুমায়ুন ফরীদির দিকেই আকর্ষিত হতো বেশি। বাণিজ্যিক আর বিকল্প ধারা মিলিয়ে প্রায় ২৫০টি ছবিতে অভিনয় করেছেন।
হুমায়ুন ফরীদির সব কাজ নিয়ে বললে শেষ হবে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নেগেটিভ চরিত্রে তার এই দুর্দান্ত অভিনয় দেখে নাটক শেষ হবার পরপরই চিত্র পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকন ১৯৯১ সালের দিকে রোজার ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সন্ত্রাস’ চলচ্চিত্রে খল চরিত্রে অভিনয়ের আমন্ত্রন জানান। ফরীদি টেলিভিশনকে লম্বা সময়ের জন্য বিদায় জানিয়ে চলচ্চিত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নেগেটিভ, পজেটিভ অর্থাৎ নায়ক-খলনায়ক দু’চরিত্রেই তিনি ছিলেন সাবলীল, এক কথায় ভার্সেটাইল। এক সময়ে মানুষ আর নায়ককে না, এক ভিলেনকে দেখতেই হলে যেতেন। সেই অপ্রতিদ্বদ্বী খলনায়ক ফরীদি প্রায় দেড় দশক দর্শকদের চুম্বকের মতো সিনেমা হলে আটকে রাখেন। বাংলা চলচ্চিত্রের পরিচালকরা তার প্রতিভার কোন ব্যবহারই করতে পারেননি। হাতে গোনা দু’তিনটি চলচ্চিত্র ছাড়া প্রায় সব চলচ্চিত্রেই তিনি মুলত এই রমজান চরিত্রটিরই পুনরাবৃত্তি করেছেন। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রসঙ্গে টিভির এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, ‘বাণিজ্যিক ছবির অভিনেতার কাজ হচ্ছে ছবিটাকে বিক্রয়যোগ্য পণ্য করে তোলা। তাই সেখানে কারেক্ট অভিনয়ের দরকার নেই।’ হুমায়ুন ফরীদির স্মৃতি রোমন্থন করে তাঁর বন্ধু বিখ্যাত জাদুকর জুয়েল আইচ বলেন, ‘হুমায়ুন ফরীদি কেন যে আমাকে এত ভালোবাসত জানি না। ফরীদির তখনো পয়সাপাতি হয় নাই। একদিন আমাকে দাওয়াত করল। তখন সে থাকত ভিকারুন নেসা স্কুলের উল্টো দিকের একটি ছোট্ট বাসায়। বলল, বন্ধু ! তুমি আমার বাসায় আসবে, একসঙ্গে খাব। তুমি কী খেতে পছন্দ কর? বললাম, কী খাব! সবই তো খাই। সে বলল, তবুও বল। বললাম, মাছ আর ডাল হলে মহাখুশি। তারপর নির্দিষ্ট দিনে গেলাম, প্রচুর আড্ডা হলো। এরপর খাবারের জন্য ডাকল কাজের ছেলেটি। ওমা, গিয়ে তো চোখ উপরে ওঠার মতো অবস্থা! এমন কোনো মাছ নেই যে সে দুটো খাবার টেবিলে সাজিয়ে রাখেনি। এর মধ্যে এমন এমন মাছও আছে যেগুলো আমরা ছোটবেলাতে কাদার মধ্যে ধরতাম। বললাম, একি করছ পাগল? সে বলল, বন্ধু তুমি তো বলেছ মাছ খেতে পছন্দ কর, তাই এই আয়োজন। পরে জেনেছি, সে ভোর রাত্রীতে উঠে ঢাকা শহরে সব জায়গা ঘুরেছে। যত মাছ দেখেছে তা থেকে কিছু কিছু কিনেছে। ফরীদি ছিল এমনি দিলখোলা মানুষ।’
ব্যক্তিগত জীবনে হুমায়ুুন ফরীদি দুবার বিয়ে করেন। প্রথম বিয়ে করেন ১৯৮০’র দশকে। ‘দেবযানী’ নামের তাঁর এক মেয়ে রয়েছে এ সংসারে। পরবর্তীতে বিখ্যাত অভিনেত্রী সুবর্ণা মোস্তাফাকে তিনি বিয়ে করলেও তাঁদের মধ্যেকার বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে ২০০৮ সালে। ২০০৪ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন হুমায়ুুন ফরীদি। নাট্যাঙ্গনে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানের ৪০ বছর পুর্তি উপলক্ষে তাঁকে সম্মাননা প্রদান করেন। একান্ত ব্যক্তিজীবনে অসম্ভব অভিমানী এই শিল্পী জীবনকে পিষে-ঘষে-পুড়িয়ে জীবন ধরার চেষ্টা করে গেছেন। এখনও চোখ মুদলে তাঁর অট্টহাসিতে কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনি। কিন্তু হুমায়ুন ফরীদি ভক্তদের একটা আক্ষেপ এখনও তাড়া করে ফেরে। এরকম অসামান্য অভিনেতা জীবিত অবস্থায় তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘একুশে’ পদক কেন পেলেন না? শব উৎসবের দীর্ঘ সময় পর তাকে কেন দেওয়া হয়েছিল একুশে পদক! তাঁকে যথাযথ সম্মান কেন দেওয়া হয়নি, সে প্রশ্ন এখন অবান্তর! আসলে মঞ্চ, টিভিনাট্য কিংবা চলচ্চিত্র ইতিহাসে চিরভাস্বর এবং অসামান্য মেধাবী জাঁদরেল অভিনেতার এ দেশে জন্মটাই ছিল সব মেধা উজাড় করে দেওয়ার; প্রাপ্তিটা ধোঁয়াশা। তবে ফরিদী ভক্তদের সকল আক্ষেপ, কষ্ট আর হতাশা মেঘ হয়ে ভেসে বেড়াবে বিস্তত দিগন্তে …হয়তোবা একসময় মিলিয়ে যাবে সুদুর নক্ষত্র গহবরে।

Pantho Afzal -পান্থ আফজাল

- Advertisement -spot_img
সর্বশেষ

ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাবে ইলন মাস্কের টেসলা বিপদে!

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাবে ইলন মাস্কের বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলা বিপদের মুখে পড়তে পারে। প্রতিষ্ঠানটি সতর্ক...