26 C
Dhaka
শনিবার, ডিসেম্বর ২০, ২০২৫

অসময়ে উত্তরে নদী ভাঙ্গন, কোথায় ঠাঁই নেবে নিঃস্ব পরিবারগুলি

জনপ্রিয়
- Advertisement -
Your Ads Here
100x100

‘কপালে কী আছে আল্লাহ জানে! কে জায়গা দেবে আমাক। ঘর দুয়ার ভাঙি নিয়া পশ্চিমের গাছবাড়িত রাখছি। তিন ছেলে-মেয়ে নিয়া কই যাবো কিছুই জানি না।’ দুধকুমার নদের ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে এভাবেই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা জানালেন কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের বানিয়াপাড়ার বাসিন্দা তাইজুল ইসলাম। গত সোমবার (৬ অক্টোবর) আকস্মিক নদীভাঙনের শিকার হয়ে বসতভিটা হারান তিনি।

দুধকুমারের আগ্রাসী রূপের বর্ণনা করে তাইজুল বলেন, ‘আগেও ভাঙছে। কিন্তু এমন ছিল না। এমনভাবে ভাঙছে মনে হয় সউগ ক্যালে (ছিলিয়ে) নিয়া গেইছে। এক রাইতে অন্তত দুইশ গজের বেশি জায়গা খাইছে।’

‘আমরা তো ভাঙনের জন্য প্রস্তুতি নিই। যেহেতু চরে থাকি সেহেতু ভাঙনের আগেভাগে বুঝতে পারি। একদিনে আর কতদূর ভাঙবে। কিন্তু এমনভাবে ভাঙছে যে, সব শ্যাষ করি দিছে’ দুধকুমারের চিরচেনা রূপের আকস্মিক পরিবর্তন নিয়ে এমন ভাষ্য তাইজুলের।

শরতের শেষ ভাগে ভারী বৃষ্টিপাত ও উজনের ঢলে সৃষ্ট আকস্মিক ভাঙনে শুধু তাইজুল নন, বানিয়াপাড়া গ্রামের দিনমজুর হাফিজুর, গৃহবধূ মনছনা বেগমসহ অন্তত ৩০টি পরিবার রাতারাতি বসতভিটা হারিয়েছেন। অনেকে নিরুপায় হয়ে নতুন আশ্রয়ের খোঁজে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। পরবর্তী ঠিকানা কী হবে, সন্তানদের লেখাপড়া আর নিজেদের জীবন-জীবিকার কথাও জানা নেই তাদের।

মনছনা বেগম ভিটেমাটি থেকে ভেঙে নেওয়া ঘর ও আসবাবপত্র নৌকায় তুলে সাময়িক আশ্রয়ের খোঁজে বানিয়াপাড়া থেকে চর নারায়ণপুরে স্থানান্তরিত হয়েছেন। মুখে কাপড় গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে মনছনা বলেন, ‘জায়গা নাই। কোথায় যাবো? সব ভেঙে ভাইয়ের বাড়ি নারায়ণপুরে পাঠালাম। এখানে ছিলাম বাচ্চাদের লেখাপড়া করাইছি। ওখানে তো পারবো না। ছেলেদের লেখাপড়া শেষ হয়া গেলো।’

বর্ষা পেরিয়ে শরতের শেষভাগে ভারী বৃষ্টিপাত আর হঠাৎ ঢলে কুড়িগ্রামের নদ-নদীগুলো আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। যে সময় নদ-নদীগুলো নিস্তরঙ্গ থাকার কথা সেসময় পানির সমতল হ্রাস-বৃদ্ধিতে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে একের পর এক বসতি, আবাদি জমি আর স্থাপনা। নিঃস্ব হচ্ছে শত শত পরিবার।

সম্প্রতি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে ধরলা; সদর, নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারীতে দুধকুমার; উলিপুর, চিলমারী ও রৌমারীতে ব্রহ্মপুত্র এবং রাজারহাট ও উলিপুরে তিস্তার ভাঙনে শত শত বসতি ও আবাদি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। কুড়িগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চলতি বছর জুন মাস পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ১ হাজার ৪০৩টি পরিবার নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই সংখ্যা আরও বেড়েছে।

জলবায়ু ও নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ুর বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রভাবে অসময়ে অধিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বৃষ্টির ফলে আকস্মিক ঢল সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া অপরিকল্পিত ও অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বালু উত্তোলনের ফলে নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে পানি ধারণক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে চিরচেনা শান্ত নদীও হঠাৎ ক্ষুরধার স্রোত নিয়ে তীরে আচড়ে পড়ছে, বাড়ছে ভাঙন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নদী ও পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন বলেন, ‘নদীর এমন ভাঙন তীব্রতার কারণ অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এখানে দুটি প্রভাব স্পষ্ট। প্রথমত অসময়ে অত্যাধিক বৃষ্টিপাত। এটা তো বর্ষার মৌসুম নয়। শরতও শেষ। এই সময়ে এত বৃষ্টি মৌসুমের দিক থেকে অস্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, মেঘ বিস্ফোরণ বা ক্লাউড ব্লাস্ট। গত ৫ বছরে এমনটা ঘটছে। হঠাৎ করে কোনও একটি সীমিত এলাকায় অত্যাধিক পরিমাণে বৃষ্টি হচ্ছে। দুই মাস ধরে যে বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা সেটা হয়তো তিন দিনে হয়ে যাচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আরেকটা অংশ হলো সারা বছর প্রবাহ না থাকায় এই নদীগুলোর ধারণক্ষমতা কমে গেছে। ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি ধারণ করতে পারছে না। ফলে বন্যা এবং ভাঙন দেখা দিচ্ছে। সারা বছর প্রবাহ থাকলে নদী গভীর থাকে, সচল থাকে। যত বৃষ্টি হোক পানি চলে যায়, ভাঙন তৈরি করে না।’

‘দুধকুমার, ধরলা, তিস্তার অত গভীরতাও নেই। তারপরও এমন ভাঙনের পেছনে মূলত তিনটি কারণ বলবো। এর মধ্যে দুটি কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত; অসময়ে অত্যাধিক বৃষ্টি এবং ক্লাউড ব্লাস্ট। আরেকটা কারণ নদীগুলোর কাঠামো নষ্ট হয়ে পানি ধারণক্ষমতা কমে যাওয়া’ নদীভাঙনের কারণ এভাবে বিশ্লেষণ করেন শেখ রোকন।

উত্তরণের প্রশ্নের জবাবে শেখ রোকন বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলোর সমাধান বৈশ্বিকভাবে করতে হবে। কার্বন কমানো, গাছপালা লাগানো, পানি সম্পদের ব্যবস্থাপনা করে এটা করা যেতে পারে। এগুলো দীর্ঘমেয়াদে করতে হবে।’

তবে মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলো উত্তরণ করা যেতে পারে বলে মত এই নদী বিশেষজ্ঞের। তিনি বলেন, ‘নদীর উজানে যাতে কোনও বাঁধ না থাকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ভাটিতে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। সারা বছর যাতে নাব্যতা থাকে তাও নিশ্চিত করতে হবে। আরেকটা উপায় হলো বাঁশের বান্ডেলিং করে স্রোত ঘুরিয়ে দেওয়া। যাতে স্রোত এসে তীরে না লাগে, মাঝ নদীতে থাকে। এগুলো করতে পারলে আকস্মিত ভাঙন থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। এটা রাষ্ট্রীয়ভাবে কিংবা স্থানীয় কমিউনিটির অংশগ্রহণে করা যেতে পারে।’

আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি

- Advertisement -spot_img
সর্বশেষ

মোহাম্মদপুরে মা–মেয়ে হত্যাকাণ্ড: ঘটনার ৬০ ঘণ্টা পর গৃহকর্মী আয়েশা ও তার স্বামী গ্রেপ্তার

ঢাকার মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডে মা লায়লা আফরোজ (৪৮) ও মেয়ে নাফিসা লাওয়াল (১৫) হত্যাকাণ্ডের প্রায় আড়াই দিন পর গৃহকর্মী...