31 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ২৩, ২০২৫

গণপূর্তে দুর্নীতি: ড. মঈনুল ইসলাম সিন্ডিকেটের অন্ধকার চিত্র

জনপ্রিয়
- Advertisement -
Your Ads Here
100x100

 


অনুসন্ধানী প্রতিবেদক:
দীর্ঘদিন ধরেই  দুর্নীতি, ঘুষ, অনিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ঠিকাদার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে থাকার অভিযোগে সমালোচিত হয়ে আসছে সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত অধিদপ্তর । এই অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মঈনুল ইসলাম, যিনি অভ্যন্তরীণ সূত্র ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নথি অনুযায়ী, ব্যাপক কমিশন বাণিজ্য ও টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
সুত্র বলছে,  রাজনৈতিক সম্পর্ক, প্রশাসনিক প্রভাব ও ঠিকাদার সিন্ডিকেটের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক অদৃশ্য শক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছেন এই প্রকৌশলী। সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হিসেবে তার নাম এখন জড়িয়ে পড়েছে শত কোটি টাকার দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে। এই প্রতিবেদন সেই ক্ষমতাচক্রের অন্ধকার দিক উন্মোচনের চেষ্টা করেছে।
ড. মঈনুল ইসলামের কর্মজীবনের শুরু থেকেই তার কর্মকাণ্ডকে ঘিরে বিতর্ক ছিল। ১৫তম ব্যাচের সহকারী প্রকৌশলীরা যেখানে ১৯৯৫ সালের ১৫ নভেম্বর যোগ দেন, সেখানে তিনি প্রায় নয় মাস পর, ১৯৯৬ সালের ১২ আগস্ট চাকরিতে যোগ দেন। শুরু থেকেই প্রশাসনিক নিয়মের বাইরে চলা এবং প্রভাব খাটানোর প্রবণতা তার মধ্যে দেখা যায়। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো, ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন—মোট ৯ বছর ৮ মাস ২২ দিন। সাধারণ নিয়মে এত দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে একজন সরকারি কর্মকর্তার চাকরি বহিষ্কার হওয়ার কথা থাকলেও তিনি বহাল ছিলেন পদে

বাস্তবেও তাই হয়েছিল—তাকে চাকরি থেকে চূড়ান্তভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, পরে তিনি মন্ত্রণালয়ে আপিলের মাধ্যমে পুনর্বহাল হন। এ ঘটনা কেবল একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার সরাসরি ইঙ্গিত বহন করে। অভিযোগ রয়েছে যে, আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর নিকটাত্মীয় হওয়ার সুবাদে তিনি এই অস্বাভাবিক সুবিধা পান।

ড. মঈনুল ইসলামের কর্মজীবনের সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় হলো তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ। অভিযোগ রয়েছে, মাত্র তিনটি বড় প্রকল্প থেকেই তিনি শত কোটি টাকার সম্পদ সঞ্চয় করেন। অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা যায়, কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনি “মিস্টার টেন পার্সেন্ট” নামে পরিচিত ছিলেন—কারণ প্রতিটি প্রকল্প থেকে তার জন্য ১০ শতাংশ কমিশন বরাদ্দ থাকত। এই আয় থেকে গড়ে ওঠে নগদ অর্থের পাহাড়, বিলাসবহুল বাড়ি এবং বিদেশি ব্যাংক হিসাব। দুদক ও গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, তার সম্পদের একটি অংশ ইতোমধ্যেই অস্ট্রেলিয়া ও দুবাইয়ে বিনিয়োগের মাধ্যমে পাচার হয়েছে। সরকারি বেতনের সঙ্গে এই সম্পদের কোনো সামঞ্জস্য নেই।
সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিতর্কিত যুবলীগ নেতা ও ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া (জি কে) শামীমের নাম আলোচিত। ২০১৯ সালে র‌্যাবের অভিযানে গ্রেফতারের পর শামীমের সম্পদের ব্যাপক সাম্রাজ্য প্রকাশ পায়। তদন্তে দেখা যায়, গণপূর্ত অধিদপ্তরের একাধিক প্রকৌশলীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগসাজশ ছিল। ড. মঈনুল ইসলামকে শামীম সিন্ডিকেটের প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শামীমকে জিজ্ঞাসাবাদে মঈনুল ইসলামের দুর্নীতির তথ্য পাওয়া যায়। ঠিকাদার সিন্ডিকেট টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, প্রকল্প ভাগাভাগি ও কমিশন বণ্টনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছিল এবং এর সঙ্গে মঈনুল সরাসরি যুক্ত ছিলেন। একটি মামলায় ঠিকাদার আসিফ, শাহাদাতসহ ১১ জন প্রকৌশলী ৩১ কোটি টাকারও বেশি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। সব আসামি মঈনুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে।
ড. মঈনুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ দুদক ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে অনুসন্ধান শুরু করে। ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি তাকে প্রধান কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়। অনুসন্ধানকারীরা তার সম্পদ বিবরণী যাচাই করেন এবং নথি পর্যালোচনা করে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেন। দুদক জানায়, দুটি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জি কে শামীম সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শামীমকে জিজ্ঞাসাবাদে ড. মঈনুল ও মোসলেহ উদ্দীনের দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে, যা সিন্ডিকেট ও সরকারি প্রকল্পের অনিয়মের একটি সুসংগঠিত চিত্র প্রকাশ করে।
খুলনা গণপূর্ত বিভাগের কর্মকাণ্ডেও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্বাহী প্রকৌশলী অমিত কুমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে স্থানীয় ঠিকাদার মাহবুব মোল্লা লিখিত অভিযোগ করেছেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ইচ্ছাকৃতভাবে অনিয়ম করা হয়েছে, নির্দিষ্ট ঠিকাদারদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে এবং হাসপাতাল ও থানা ভবনের নির্মাণে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
এগুলো প্রমাণ করে, এটি কেবল ব্যক্তিগত দুর্নীতি নয়, বরং একটি সুসংগঠিত সিন্ডিকেটের কাজ। সিন্ডিকেটে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, মাঠপর্যায়ের প্রকৌশলী এবং প্রভাবশালী ঠিকাদাররা একত্র হয়ে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, প্রকল্পের খরচ ফাঁপানো ও কমিশন ভাগাভাগি করে দেশের অর্থ পাচার করছেন।
সরকারি প্রকল্পের লক্ষ্য হলো জনগণের কল্যাণে অবকাঠামো উন্নয়ন। কিন্তু দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের কারণে প্রকল্পের মান কমছে, কাজ বিলম্বিত হচ্ছে এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ লোপাট হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছে এবং সরকারের প্রতি আস্থা কমছে। সৎ ঠিকাদাররা প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ায় ভয় পাচ্ছেন, আর মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা সিন্ডিকেটের বাইরে থাকলে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ড. মঈনুল ইসলাম যখন রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার ছায়ায় বছরের পর বছর দুর্নীতি চালাতে পারেন, তখন এটি কেবল তার ব্যক্তিগত অপরাধ নয়, বরং পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সংকটের প্রতিফলন।
- Advertisement -spot_img
সর্বশেষ

ক্ষমা চাই : শফিকুর রহমান

খবরের দেশ ডেস্ক ; জামায়াতে ইসলামী আমির ডা. শফিকুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এক মতবিনিময় সভায় প্রকাশ্যে ১৯৪৭ সাল থেকে বর্তমান...