টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক । জন্ম: ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮২। একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেবার পার্টির রাজনীতিবিদ। তিনি ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে লন্ডনের হ্যামস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এর পূর্বে তিনি রিজেন্ট পার্কের কাউন্সিলর এবং ২০১০ সালে ক্যামডেন কাউন্সিলের কালচার অ্যান্ড কমিউনিটির সদস্য ছিলেন। তিনি ট্রেজারির অর্থনৈতিক সেক্রেটারি এবং সিটি মন্ত্রী হিসেবে ৯ জুলাই ২০২৪ থেকে ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রাথমিক জীবন
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বোন শেখ রেহেনা এবং সফিক সিদ্দিকীর মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ১৯৮২ সালে লন্ডনের মিচামে সেন্ট হেলিয়ার হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন।
মা শেখ রেহেনার সাথে টিউলিপ
তার শৈশব কেটেছে বাংলাদেশ, ভারত এবং সিঙ্গাপুরে। ১৫ বছর বয়স থেকে তিনি হ্যাম্পস্টিড ও কিলবার্নে বসবাস করছেন। এই এলাকায় স্কুলে পড়েছেন ও কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে পলিটিক্স, পলিসি ও গভর্নমেন্ট বিষয়ে তার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির সদস্য হওয়া টিউলিপ এম্ন্যাস্টি ইন্টারন্যাশনাল গ্রেটার লন্ডন অথরিটি এবং সেইভ দ্য চিলড্রেনের সঙ্গেও কাজ করেছেন। ২০১০ সালে ক্যামডেন কাউন্সিলে প্রথম বাঙালি নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হন তিনি।
টিউলিপ সিদ্দীক
রাজনৈতিক জীবন
ব্রিটেনের ৫৬ তম সাধারণ নির্বাচনে হ্যাম্পস্টিড ও কিলবার্ন আসন থেকে এমপি পদে বিজয়ী হয়েছিলেন । ২০১৫ সালের নির্বাচনে টিউলিপের জয়ের ব্যবধান ছিল এক হাজার ১৩৮ ভোট। ৭ মে ১ হাজার ১৩৮ ভোটের ব্যবধানে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থীকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছিলেন টিউলিপ।
টিউলিপ সিদ্দিকী পেয়েছিলেন ২৩ হাজার ৯৭৭ ভোট। আর কনজারভেটিভ পার্টির সায়মন মার্কাস পেয়েছেন ২২ হাজার ৮৩৯ ভোট। দুইবছর পর ২০১৭ সালে টিউলিপ সিদ্দিক আবারও জিতলেন যুক্তরাজ্যে। এবার ভোটের ব্যবধান বেড়েছে দশগুণেরও বেশি। লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে শ্রমিক দলের প্রার্থী টিউলিপ পেয়েছেন ৩৪ হাজার ৪৬৪ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ দলের প্রার্থী ক্লেয়ার লুইচ লিল্যান্ড পেয়েছেন টিউলিপের অর্ধেক ভোট। তার পক্ষে রায় দিয়েছেন মাত্র ১৮ হাজার ৯০৪ জন।
২০১৫ সালে টিউলিপ ব্রিটিশ লেবার পার্টির ছায়া মন্ত্রিপরিষদে সংস্কৃতি, গণমাধ্যম ও ক্রীড়া বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হয়।২০১৭ সালে ব্রিটেনের লেবার পার্টির ছায়া শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ সিদ্দিক এমপি
ব্যক্তিগত জীবন
স্বামী ক্রিস পার্সির সঙ্গে টিউলিপ সিদ্দিক লন্ডনে বসবাস করেন। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। মেয়ে আজালিয়া জয় পার্সি ও রাফায়েল মুজিব সেন্ট জন পার্সি
স্বামী ক্রিস পার্সির সঙ্গে টিউলিপ
বিতর্ক
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ
২০১৯ সালে, টিউলিপ বাংলাদেশের রাজনীতিতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছিলেন কিন্তু তার নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী লীগের সমর্থকদের ব্যবহার করার অভিযোগের মুখে পড়েছিলেন। ২০১৭ সালের একটি সভার ফুটেজে তাকে এসব সমর্থকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে দেখা যায়, যেখানে তিনি বলেন, “আপনাদের সমর্থন ছাড়া, আমি আমার আসনে জিততে পারতাম না।
খালা শেখ হাসিনার সাথে টিউলিপ
এর আগে, তিনি আওয়ামী লীগের ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য শাখা ও নির্বাচনী কৌশল দলের জন্য কাজ করার কথা স্বীকার করেছিলেন। দু’জন লেবার কর্মকর্তা আরও দাবি করেছিলেন যে আওয়ামী লীগ তার ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণাকে সমর্থন করেছে।
২০১৫ সালে, টিউলিপ সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন, যেটি শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষে মিথ্যা তথ্য প্রচারের অভিযোগে অভিযুক্ত। টিউলিপ ঐ অনুষ্ঠানে তার খালার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছিলেন, যদিও পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশি রাজনীতি থেকে নিজেকে আলাদা করার চেষ্টা করেছিলেন।
সি আর আই প্রকাশিত পোস্টার যেখানে টিউলিপ সিদ্দীক প্রধান বক্তা ছিলেন
২০২৪ সালের আগস্টে, দ্য টাইমস এর একটি প্রতিবেদনে এটি প্রকাশিত হয় যে টিউলিপ যে বাড়িতে বসবাস করছিলেন তা একজন ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন, যার আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
দুই বছর আগে, তিনি সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বাড়িতে বসবাস করার জন্য সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। ওই সম্পত্তিটি সালমানের ছেলের নামে একটি অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে য়াইল অব ম্যান-এ নিবন্ধিত ছিল।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে, ্দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমস এ প্রকাশিত হয় যে টিউলিপ ২০০৪ সালে আবদুল মোতালিফ নামের একজন ডেভেলপারের (যিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত) থেকে লন্ডনে একটি ফ্ল্যাট উপহার পেয়েছিলেন। এই অভিযোগের পর, তিনি একটি স্বাধীন তদন্তের জন্য মন্ত্রিপরিষদ মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কাছে আহবান জানান। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে টিউলিপকে নিয়ে তদন্তের বিষয়ে মন্ত্রিত্বের মানদণ্ডবিষয়ক স্বাধীন উপদেষ্টা লাউরি ম্যাগনাস বলেন,তৎকালীন উপহার সম্পর্কিত একটি ভূমি রেজিস্ট্রি হস্তান্তর ফর্মে স্বাক্ষর করা সত্ত্বেও টিউলিপ সিদ্দিকি কিংস ক্রসে তাঁর ফ্ল্যাটের মালিকানার উৎস সম্পর্কে অবগত ছিলেন না।
লন্ডনের হ্যাম্পস্টিড এলাকায় টিউলিপ সিদ্দিক যে ফ্ল্যাটে কয়েক বছর ধরে বসবাস করে আসছেন
বাংলাদেশে দুর্নীতির অভিযোগ
২০২৪ সালে হাসিনা সরকারের পতনের পরজাতীয়তাবাদী গণতান্রিক আন্দলনের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজের অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক টিউলিপের বিরুদ্ধে রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ার সাথে ২০১৩ সালে ঘটিত একটি চুক্তিতে মধ্যস্থতার মাধ্যমে ৫৯ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তদন্ত শুরু করে যদিও তার সমর্থিত সূত্র বলেছে এগুলো মিথ্যা অভিযোগ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
মন্ত্রিত্বের মানদণ্ডবিষয়ক স্বাধীন উপদেষ্টা লাউরি ম্যাগনাস এ বিষয়ে বলেন, যে ছবিতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে টিউলিপের খালা এ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর ছবি রয়েছে তাতে এমপি স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে কোনও আন্তঃসরকারি আলোচনায় বা কোনও ধরণের সরকারি ভূমিকায় তাঁর কোনও সম্পৃক্ততা ছিল না।
বিনামূল্যে বিশ্বকাপের ম্যাচ দেখার অভিযোগ
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে, দ্য টেলিগ্রাফ একটি প্রতিবেদনে অভিযোগ করে যে টিউলিপ এবং আওয়ামী লীগের এমপি কাজী নাবিল আহমেদ দুটি ম্যাচ বিনামূল্যে উপভোগ করেছিলেন। প্রতিটি টিকিটের মূল্য ছিল £৩৫৮.৮০ ব্রিটিশ পাউন্ড যা বাংলাদেশি মুদ্রাইয় (প্রায় ১ লক্ষ টাকা), যার মধ্যে লাঞ্চ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ
দুর্নীতির একাধিক অভিযোগে বাংলাদেশে তদন্ত শুরুর পর সমালোচনার মুখে পদত্যাগ করলেন টিউলিপ সিদ্দিক। যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনীতিবিষয়ক মিনিস্টার (ইকোনমিক সেক্রেটারি) ছিলেন তিনি। সিটি মিনিস্টার হিসেবে পরিচিত এই পদে থেকে টিউলিপ সিদ্দিক যুক্তরাজ্যের আর্থিক খাতে দুর্নীতি দমনের দায়িত্বে ছিলেন।
মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন টিউলিপ। প্রধানমন্ত্রী স্টারমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন।
পদত্যগপত্রে টিউলিপ উল্লেখ করেন, তিনি ভুল কিছুই করেননি। পদত্যাগের কারণ হিসেবে টিউলিপ বলেন, এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ইকোনমিক সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেলে সেটা সরকারের কাজ থেকে মনোযোগ ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে পারত।
দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাঁরও নাম আসার বিষয়টি নিয়ে টিউলিপ পদত্যাগপত্রে লিখেছেন, ‘পরিবারেরসঙ্গে আমার সম্পৃক্ততার বিষয়টি সবাই জানে। যখন আমি মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিই, সে সময় আমি আমার পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছি।’
পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের জন্য টিউলিপকে চিঠি দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। টিউলিপের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর এ নিয়ে মন্ত্রিসভার সদস্যদের বিধিবিষয়ক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা লাউরি ম্যাগনাস তদন্ত করেছেন। সেই তদন্তের বিষয়টি উল্লেখ করে কিয়ার স্টারমার টিউলিপকে জানান, তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা কোনো অভিযোগের প্রমাণ পাননি ম্যাগনাস। স্টারমার বলেন, ‘আপনার (টিউলিপ) জন্য দরজা খোলা রইল।’