21 C
Dhaka
বুধবার, ডিসেম্বর ১৭, ২০২৫

অসময়ে ভাঙন নদী ভাঙ্গন ও জলবায়ু পরিবর্তন; নিঃস্ব সম্বলহীন কুড়িগ্রামের নদীপাড়ের মানুষ

জনপ্রিয়
- Advertisement -
Your Ads Here
100x100
আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:
জলবায়ুগত পরিবর্তনসহ একাধিক কারণে এবার কুড়িগ্রামের নদী পাড়ের মানুষের জীবনে আকস্মিক পরিবর্তন এসেছে। তীব্র বন্যা না থাকলেও দেখা দিচ্ছে ভাঙন। ভিটে-মাটি সহায়- সম্বল হারিয়ে দিশেহারা নদী পাড়ের পরিবারগুলো। বর্ষা পেরিয়ে শরতের শেষভাগে যে সময় নদ-নদীগুলো নিস্তরঙ্গ থাকার কথা সেসময় পানির সমতল হ্রাস-বৃদ্ধিতে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে একের পর এক বসতি, আবাদি জমি আর স্থাপনা। নিঃস্ব হয়েছে শত শত পরিবার।
কুড়িগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য-উপাত্ত বলছে, চলতি বছর জুন মাস পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ১ হাজার ৪০৩টি পরিবার নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এই সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে তারা জানিয়েছে।  তেমন ভারি কোনো বর্ষণ না থাকলেও উজানি ঢলের কারণে এবছর অক্টোবরের শুরুতে কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলায় ও সদর উপজেলায় ধরলা, নাগেশ্বরী উপজেলায় ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলায়  দুধকুমার, উলিপুর উপজেলায় ও চিলমারী উপজেলায় এবং রৌমারী উপজেলায় ব্রহ্মপুত্র ও রাজারহাট উপজেলায় ও উলিপুর উপজেলায় তিস্তার ভাঙনে শত শত বসতি ও আবাদি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে।
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সরেজমিনে কুড়িগ্রাম জেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, নদী পাড়ের বাড়ির শেষ সম্বলটুকু রক্ষা করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন সেখানকার বাসিন্দারা। দুধকুমার যেন একে একে গিলে খাচ্ছে তাদের ভিটেমাটি সহায়-সম্বল। এই নদী পাড়ের বাসিন্দা আব্দুল আজিজ বলেন, এবার অসময়ে বন্যা হইছে গত বছর এই সময় এমন বন্যা হয় নি। তিনি আরাও বলেন, আগেও ভাঙছে। কিন্তু এমন ছিল না। এমনভাবে ভাঙছে মনে হয় সোগ সাথেনিয়া গেইছে। গত এক রাইতে কম করি হলেও দুইশ’ গজের বেশি জায়গা খাইছে।’
একই এলাকার আরেক বাসিন্দা মোঃ তাইজুল ইসলাম বলেন, ‘কপালত কী আছে আল্লাহ জানে! কে জায়গা দেবে আমাক। ঘর দুয়ার ভাঙি নিয়া পশ্চিমের গাছবাড়িত রাখছি। তিন ছেলে-মেয়ে নিয়া কোনটে যামো কিছুই জানি না। তিনি আরও বলেন, ‘গত ৬ অক্টোবর বাড়িঘর দুধকুমার ভাঙ্গি নিয়া গেছে। সেই থাকি মাইষের জাগাত আছি।’ আরেক বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন, ‘প্রতি বছর আমরা ভাঙনের প্রস্তুতি নেই বন্যার সময়, যখন বর্ষাকাল আসে। এবার আমাদের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। হুটহাট নদী ভাঙন শুরু হইছে।’ নিজ বাড়ি হারিয়ে এখন তার মামার বাড়ি নাগেশ^রীতে সেখানে মাথা গোজার ঠাঁই খুঁজতে।’
অক্টোবর মাসের শুরুতে শরতের শেষ ভাগে ভারি বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলে সৃষ্ট আকস্মিক ভাঙনে শুধু আজিজ রবিউল নয়, এই এলাকার অন্তত ৩০টি পরিবার রাতারাতি বসতভিটা হারিয়েছেন। অনেকে নিরুপায় হয়ে নতুন আশ্রয়ের খোঁজে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। পরবর্তী ঠিকানা কী হবে, সন্তানদের লেখাপড়া আর নিজেদের জীবন-জীবিকার কথাও জানা নেই তাদের।
এখন পর্যন্ত এই যাত্রাপুর ইউনিয়নের বানিয়োপাড়া গ্রামের মোছাঃ মনছনা বেগমের বাড়ি ভেঙেছে ৬ বার। তবে এবার অসময়ে ঘর ভেঙে যাওয়ার অনেকটা হতাশাগ্রস্ত তিনি। সাময়িক আশ্রয়ের খোঁজে তিনি যাবেন তার আত্মীয় বাড়ি পাশের অন্য এক চরে। তিনি বলেন, ‘আমগো যাওনের কোনো জায়গা নাই। ভাবছিলাম এবার আর বন্যা আইবো না। কিন্তু বন্যা না আইলেও ভাঙন আইছে। পোলাপান নিয়া ক্যামনে চলুম আল্লাহ জানে।’
জলবায়ু ও নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ুর বৈশিক পরিবর্তনের প্রভাবে অসময়ে অধিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বৃষ্টির ফলে আকস্মিক ঢল সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া অপরিকল্পিত ও অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বালু উত্তোলনের ফলে নদীগুলোর নাব্য হারিয়ে পানি ধারণক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে চিরচেনা শান্ত নদীও হঠাৎ ক্ষুরধার স্রোত নিয়ে তীরে আচড়ে পড়ছে, বাড়ছে ভাঙন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নদী ও পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন বলেন,  বর্ষার শেষে শরৎকালে নদীর এমন ভাঙন তীব্রতার কারণ অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।
এখানে দুটি প্রভাব স্পষ্ট। প্রথমত অসময়ে অত্যাধিক বৃষ্টিপাত। এটা তো বর্ষার মৌসুম নয়। শরৎও শেষ। এই সময়ে এত বৃষ্টি মৌসুমের দিক থেকে অস্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, মেঘ বিস্ফোরণ বা ক্লাউড ব্লাস্ট। গত ৫ বছরে এমনটা ঘটছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নদীর এমন আগ্রাসী রুপের আরেকটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো সারাবছর প্রবাহ না থাকায় এই নদীগুলোর ধারণক্ষমতা কমে গেছে। ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি ধারণ করতে পারছে না। ফলে বন্যা এবং ভাঙন দেখা দিচ্ছে। সারা বছর প্রবাহ থাকলে নদী গভীর থাকে, সচল থাকে।
যত বৃষ্টি হোক পানি চলে যায়, নতুন করে আর ভাঙন হয় না।’ ধরলা, দুধকুমার ও তিস্তার ভাঙনের পেছনেও এই কারণগুলো আছে বলে মন্তব্য করেন।’ কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, নদী ভাঙনের সমাধান হচ্ছে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ। তবে তারা জরুরি ভিত্তিতে নদী ভাঙন এলাকা রক্ষা করতে তাৎক্ষণিকভাবে জিও ব্যাগ ফেলেন।
জানতে চাইলে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ রাকিবুল হাসান বলেন, ‘জেলায় এই  বর্ষায় ৩৭টি পয়েন্টে ৫.৪৭ কিলোমিটার এলাকায়  ৩৩ কোটি টাকার জিও ব্যাগের কাজ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘কুড়িগ্রামে নদী অববাহিকাগুলোর ১০০ কিলোমিটার নদী এখনো অরক্ষিত আছে সেখানে ব্লক দিয়ে  প্রটেকশন দিলে স্থায়ী সমাধান পাওয়া যাবে। সেখানে আনুমানিক  ব্যয় হবে  ১০ হাজার কোটি টাকা।’ নদী ও পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন মনে করেন নদী ভাঙন, খরা বন্যা এসব বিষয় সমাধানের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলোর সমাধান বৈশি^কভাবে করতে হবে। কার্বন কমানো, গাছপালা লাগানোসহ অন্য কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।’
- Advertisement -spot_img
সর্বশেষ

মোহাম্মদপুরে মা–মেয়ে হত্যাকাণ্ড: ঘটনার ৬০ ঘণ্টা পর গৃহকর্মী আয়েশা ও তার স্বামী গ্রেপ্তার

ঢাকার মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডে মা লায়লা আফরোজ (৪৮) ও মেয়ে নাফিসা লাওয়াল (১৫) হত্যাকাণ্ডের প্রায় আড়াই দিন পর গৃহকর্মী...