| Your Ads Here 100x100 |
|---|
আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি
বাঁশের বান্ডালের পাশাপাশি জিও ব্যাগ দিয়ে জিঞ্জিরাম নদের তীরের ভাঙন রোধের চেষ্টা চলছে। গত শনিবার বিকেলে কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলার যাদুরচর ইউনিয়নের বকবান্ধা এলাকার ব্যাপারীপাড়ায়
বাঁশের বান্ডালের পাশাপাশি জিও ব্যাগ দিয়ে জিঞ্জিরাম নদের তীরের ভাঙন রোধের চেষ্টা চলছে।
কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলার সায়দাবাদ ঘাট থেকে বকবান্ধা ব্যাপারীপাড়ায় নৌকায় যেতে প্রায় ৪০ মিনিট সময় লাগে। সড়কপথে সেখানে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। ভারতের আসাম রাজ্য থেকে বাংলাদেশে ঢুকে জিঞ্জিরাম নদটি ওই এলাকায় এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে। এর দুই তীরে এখন শর্ষে, মাষকলাই ও ভুট্টার বিস্তীর্ণ খেত। সেই সঙ্গে এখানে–সেখানে টানানো মাছ ধরার জাল দেখে অনুমান করা যায়, অঞ্চলটির মানুষের জীবনযাত্রার প্রধান নির্ভরতার মাধ্যম এই নদ। কিন্তু জিঞ্জিরামের শান্ত সৌন্দর্যের ভেতর লুকিয়ে আছে ভয়ও।
কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার যাদুরচর ইউনিয়নের বকবান্ধা গ্রামের লোকজন কৃষি, মাছ ধরা ও দিনমজুরির আয়ে সংসার চালান। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উজানের অতিবৃষ্টিতে ঢল নামে ভাটির জিঞ্জিরামে। তখন নদটি বেশ আগ্রাসী হয়ে ওঠে; ভাঙনে হারিয়ে যায় ঘরবাড়ি, জমিজমা কিংবা শেষ সম্বলটুকুও।
বকবান্ধা গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে নদের ভাঙন নতুন কোনো সংকট নয়। তবে ২০২৪ সালের শেষ দিকে শুরু হওয়া এক প্রচেষ্টায় সাময়িকভাবে কমে যায় জিঞ্জিরাম নদের তীরের মানুষের সংকট। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আরডিআরএস বাংলাদেশের ‘ট্রোসা–২’ প্রকল্পের সহায়তায় নদের তীরের বিভিন্ন বয়সী ও শ্রেণি–পেশার মানুষ একসঙ্গে ‘নদী বৈঠক’ করেন। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয়, বড় বাঁধ নয়; বরং দ্রুত কার্যকর ও স্বল্প খরচের সমাধানের দিকে যেতে হবে। এ থেকে বাঁশের বান্ডাল (বেড়া) তৈরির সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, তাঁদের চাঁদার টাকা, ইউনিয়ন পরিষদের সহায়তা ও প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কারিগরি পরামর্শে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৬০০ মিটার এলাকায় ২৭টি বাঁশের বান্ডাল স্থাপন করা হয়। বান্ডালগুলো স্রোতকে মাঝপথে প্রতিহত করে তীরের দিকে চাপ কমাতে সাহায্য করে।
তবে নৌযান চলাচল, বর্ষার অতিরিক্ত পানির স্রোত ও উজানের পাহাড়ি ঢলের তীব্রতার কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা বুঝতে পারেন, শুধু বান্ডালই ভাঙন ঠেকাতে যথেষ্ট নয়। ৪ জুন স্থানীয় ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডে (পাউবো) গিয়ে জিও ব্যাগের জন্য আনুষ্ঠানিক আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে জুলাইয়ে বকবান্ধায় জিও ব্যাগ সরবরাহ করা হয়। পরে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে স্থানীয় বাসিন্দারা এগুলো দিয়ে বান্ডালের পাশেই আরও মজবুত সুরক্ষা বলয় তৈরি করেন। এতে অন্তত ৪০০ পরিবার ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছেন বলে দাবি একাধিক বাসিন্দার।
গত শনিবার বকবান্ধা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, জিঞ্জিরাম নদের তীরে বাঁশের বান্ডাল ঘিরে বাঁধসংলগ্ন বসতভিটায় সবজি রোপণের কাজ করছেন আনুজা বেগম (৫০)। তিনি বলেন, জিঞ্জিরামের ভাঙন থেকে রক্ষা পেতে এলাকার সবাই চাঁদা দিয়েছেন। এরপর তাঁরা স্বেচ্ছায় কাজ করেছেন।
আনুজার ভাষ্য, এলাকার ধনী–গরিব সব ঘর থেকে টাকা তোলা হয়েছে। ৫০ হাজার টাকা ওঠে। পরে ইউনিয়ন পরিষদ এক লাখ টাকা দেয়। মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে বান্ডাল বানিয়েছেন। প্রকল্প থেকেও টাকা ও কারিগরি সহায়তা পেয়েছেন সবাই।
অস্থায়ী এই উদ্যোগের কারণে জিঞ্জিরাম নদের তীরে ভাঙন কমে বাসিন্দাদের মনে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে।
বাঁশের বান্ডাল ও জিও ব্যাগের সমন্বিত শক্তির কারণে চলতি বছর বকবান্ধায় নদের ভাঙন দেখা দেয়নি বলে জানিয়েছেন প্রবীণ বাসিন্দা গুলু মিয়া (৭০)। তিনি জিঞ্জিরামপাড়ে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘এই নদীর পাড়ে আমার বাপ–দাদার ১০ বিঘা জমি আছিল। ভাঙতে ভাঙতে এহন বসতভিটা ছাড়া আর কিছু নাই।’
অস্থায়ী এই উদ্যোগের কারণে জিঞ্জিরাম নদের তীরের বাসিন্দাদের মনে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। তবে আশঙ্কাও আছে। তাঁদের ভাষ্য, নদের তীরে স্থায়ী সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে ভাঙন আবার ফিরে আসবে। স্থায়ী বাঁধ না হওয়ায় বকবান্ধা নামাপাড়া ও ব্যাপারীপাড়ার চার শতাধিক পরিবার এখনো ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে। এ ছাড়া স্থানীয় বাজার, দুটি মসজিদ, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ঈদগাহ মাঠ ও কবরস্থান হুমকির মুখে।
ইউপি সদস্য ময়নাল হক বলেন, ‘উজানে ভারী বৃষ্টি মানেই, ভাটিতে আমাগো দুশ্চিন্তা। গত বছর ঢলের স্রোত খুব তীব্র আছিল। বান্ডাল না দিলে এই এলাকা রাইখা দিত না। কিন্তু স্থায়ী বাঁধ দরকার।’
ট্রোসা–২ প্রকল্পের সহকারী কর্মকর্তা মোঃ আবদুর রহিম খন্দকার বলেন, ‘আমরা স্থানীয় মানুষের এই কাজকে টেকসই করতে অর্থ ও কারিগরি সহায়তা দিয়েছি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের জিও ব্যাগ, ট্রোসা–২ প্রকল্পের পরামর্শ ও স্থানীয় লোকজনের স্বেচ্ছাশ্রম—এই তিন বিষয়ের সমন্বয়ে বকবান্ধা ব্যাপারীপাড়ার জিঞ্জিরামপাড় এখন ভাঙনমুক্ত হয়েছে।’
জানতে চাইলে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ রাকিবুল হাসান বলেন, সরেজমিনে পরিদর্শন করে স্থানীয় বাসিন্দাদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে জিও ব্যাগ সরবরাহ করা হয়। স্থানীয় লোকজন স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে সেখানে জিও ব্যাগ ও বাঁশ দিয়ে অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করেছেন। এ বিষয়ে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

